রাত্রে আহারাদির পর কাসেম কয়েকজন মাতব্বর লোক লইয়া এক মজলিস বসাইল এবং তাহাদের এই একমাত্র পীরবংশধর যে পৈতৃক ব্যবসায় পরিত্যাগ করিয়া হতভাগ্য মুরীদগণের পারত্রিক কল্যাণ সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন হইয়া পড়িয়াছেন ইহাই লইয়া নানা ছন্দোবন্ধে দুঃখ প্রকাশ করিতে আরম্ভ করিল। এই পীরগোষ্ঠী যে কত বড় কেরামতকুশল, সমাগত লোকদিগকে তাহা বুঝাইবার জন্য সে আবদল্লাহর পূর্বপুরুষগণের বিষয়ে অনেক গল্প বলিতে লাগিল।
প্রথম যিনি আরব হইতে পীরগঞ্জে আসেন–সে কত কালের কথা, তাহার ঠিকানা নাই;–তিনি প্রকাও এক মাছে চড়িয়া সাগর পার হইয়াছিলেন; তাই তাহাকে সকলে মাহী সওয়ার বলিত। তিনি কত বড় পীর ছিলেন, তাঁহার দস্ত মোবারকের স্পর্শমাত্রেই কেমন করিয়া মরণাপন্ন রোগীও বাঁচিয়া উঠিত, ঘরে বসিয়াই তিনি কেমন করিয়া বহু ক্রোশ দূরবর্তী নদীবক্ষে মজ্জমান নৌকা টানিয়া তুলিয়া ফেলিতেন এবং সেই ব্যাপারে কিরূপে তাঁহার আস্তিন ভিজিয়া যাইত, আকাশে হাত তুলিয়া আও আও বলিয়া ডাকিতেই কোথা হইতে হাজার হাজার কবুতর আসিয়া জুটিত এবং তিনি হাত নাড়িয়া কী প্রকারে আস্তিনের ভিতর হইতে রাশি রাশি ধান, ছোলা, মটর প্রভৃতি বাহির করিয়া তাহাদিগকে খাওয়াইতেন, সে সকল ঘটনা সালঙ্কারে বর্ণনা করিয়া কাসেম সকলকে স্তম্ভিত ও চমৎকৃত করিয়া দিল। আবার শুধু তিনিই যে একলা পীর ছিলেন, এমত নহে, তাহার বংশেও অনেক বড় বড় পীর জন্মিয়া গিয়াছেন; এমনকি, কেহ কেহ শিশুকালেই এমন আশ্চর্য কেরামত দেখাইয়াছেন যে তাহা ভাবিলেও অবাক হইতে হয়। মাহী সওয়ার পীর সাহেবের পৌত্র কিংবা প্রপৌত্রের একটি বড় আদরের কাঁঠাল গাছ ছিল। একবার তাহাতে একটিমাত্র কাঁঠাল ফলিয়াছিল, সেটা তিনি নিজে খাইবেন বলিয়া ঠিক করিয়া রাখিয়াছিলেন। কিন্তু তাহার অনুপস্থিতকালে তাহার এক বালক-পুত্র ঐ কাঁঠালটি পাড়িয়া খাইয়া ফেলেন। বাটী আসিয়া পীর সাহেব যখন দেখিলেন যে গাছে কাঁঠাল নাই, তখন তিনি বড়ই রাগান্বিত হইয়া সকলকে জিজ্ঞাসা করিতে লাগিলেন, কে উহা খাইয়াছে। সকলেই জানিত, কিন্তু ভয়ে কেহ বলিল না। অবশেষে তিনি পুত্রের বিমাতার নিকট জানিতে পারিলেন কাহার এই কাজ। তখন পুত্রের তলব হইল; কিন্তু তিনি অস্বীকার করিলেন এবং কহিলেন, কেন, বাপজান, কেহ তো সে কাঁঠাল খায় নাই, গাছের কাঁঠাল গাছেই আছে!
তাহার পর পীর সাহেব গিয়া দেখেন, সত্য সত্যই গাছের কাঁঠাল গাছেই ঝুলিতেছে! দেখিয়া তো তিনি অবাক হইয়া গেলেন, কিন্তু ব্যাপার কী, তাহা বুঝিতে বাকি রহিল না। তখন তাহার বড় গোস্বা হইল; তিনি বলিলেন, কেয়া এক ঘরমে দো পীর। যাও বাচ্চা, সো রহো। সেই যে বাচ্চা গিয়া শুইয়া রহিলেন, আর উঠিলেন না!
আবদুল্লাহ্ নিতান্ত নিরুপায় হইয়া বসিয়া বসিয়া কাসেমের এই সরল বিশ্বাসের উচ্ছ্বাস-রঞ্জিত উপাখ্যানগুলি জীর্ণ করিতেছিল। ক্রমে রাত্রি অধিক হইয়া চলিল দেখিয়া
অবশেষে মজলিস ভঙ্গ করিয়া সকলে উঠিয়া গেল। অতঃপর আবদুল্লাহ্ শুইয়া শুইয়া ভাবিতে লাগিল, পুত্রের পীরত্বে পিতার হৃদয়ে এরূপ সাংঘাতিক হিংসার উদ্রেক আরোপ করিয়া ইহারা পীর মাহাত্ম্যের কী অদ্ভুত আদর্শই মনে মনে গড়িয়া তুলিয়াছে!
.
০৪.
বহু কষ্টে বৃদ্ধ কাসেম গোলদারের সরল ভক্তিজাল ছিন্ন করিয়া পরদিন বৈকালে আবদুল্লাহ্ একবালপুরে পৌঁছিল।
আবদুল্লাহর বড় সম্বন্ধী আবদুল মালেক এইমাত্র নিদ্রা হইতে উঠিয়া বৈঠকখানার বারান্দার এক প্রান্তে জলচৌকির উপর বসিয়া ওযু করিতেছিলেন। লোকটি হাফেজ এবং উকট পরহেজগার; ওযুর সময় কথা বলিলে গোনাহ্ হইবে বলিয়া, কেবল একটুখানি মুচকি হাসিয়া তিনি আপাতত ভগ্নীপতির অভ্যর্থনার কাজ সারিয়া লইলেন এবং পুনরায় সযত্নে ওযু ক্রিয়ায় মনোনিবেশ করিলেন। ওযু শেষে উঠিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, তারপর দুলা মিঞা ধরগে’ তোমার কী মনে করে? খবর ভালো তো?
আবদুল্লাহ্ তাহার কদমবুসি করিয়া কহিল, জি হাঁ, ভালোই। আপনি কেমন আছেন?
আমি ভালো। একটু বোস ভাই, আমি আসরের নামায পড়ে নিই। এই বলিয়া আবদুল মালেক নামায পড়িতে গেল।
এদিকে চাকর মহলে দুলা মিঞা এয়েছেন, দুলা মিঞা এয়েছেন বলিয়া একটা কলরব উঠিল এবং দেখিতে দেখিতে উহা অন্দরমহল পর্যন্ত সংক্রামিত হইয়া পড়িল। কয়েকটা বাঁদী দরজার প্রান্তদেশ হইতে মুখ বাড়াইয়া জিজ্ঞাসা করিল, কোন্ দুলা মিঞা রে? চাকরেরা জবাব দিল, পীরগঞ্জের দুলা মিঞা।
বাঁদীরা সেই সংবাদ লইয়া অন্দরের দিকে দৌড়িয়া গেল।
দুলা মিঞার আগমন-সংবাদে, অন্দর হইতে একদল ঘোট ঘোট শ্যালক ছুটিয়া আসিল, –কেহ কেহ আবদুল্লাহর নিকটে আসিয়া কদমবুসি করিল, এবং নিতান্ত ছোটগুলি একটু তফাতে দাঁড়াইয়া মুখে আঙুল দিয়া চাহিয়া রহিল।
আবদুল্লাহ্ ইহাদিগের সহিত একটু মিষ্টালাপ করিতেছে, এমন সময় আবদুল মালেক নামায পড়িয়া উঠিয়া একজন চাকরকে ডাকিয়া কহিলেন, ওরে, দুলা মিঞার ওযুর পানি দে।
আবদুল্লাহ্ ওযু করিতে করিতে জিজ্ঞাসা করিল, আবদুল কাদের কোথায়?
আবদুল মালেক কহিল, ওঃ, সে আজ ধরগে’ তোমার মাস তিনেক হল বাড়ি ছাড়া।
কেন কোথায় গেছে?
খোদা জানে, কোথায় গেছে! আব্বার সঙ্গে ধরগে’ তোমার একরকম ঝগড়া করেই চলে গেছে।