.
০৩.
আবদুল্লাহ্ যখন শাহপাড়ার গোলদার-বাড়ি আসিয়া পৌঁছিল, তখন বেলা প্রায় দ্বিপ্রহর। সংবাদ পাইয়া গৃহস্বামী কাসেম গোলদার ব্যস্ত–সমস্ত হইয়া ছুটিয়া আসিল এবং তাহার দীর্ঘ শুভ্র শ্মশ্রুরাজি ভূলুণ্ঠিত করিয়া আবদুল্লাহর কদমবুসি করিতে উদ্যত হইল! এ ধরনের অভিনন্দনের জন্য আবদুল্লাহ্ একেবারেই প্রস্তুত ছিল না। পথে হঠাৎ সাপ দেখিলে মানুষ যেমন এক লম্ফে হটিয়া দাঁড়ায়, সেও তেমনি হাটিয়া গিয়া বলিয়া উঠিল, আহা, করেন কী, করেন কী, গোলদার সাহেব!
কাসেম গোলদার বড়ই সরলপ্রাণ, ধর্মপরায়ণ, পীরভক্ত লোক। আবদুল্লাহর পিতা তাহার পীর ছিলেন; এক্ষণে তাহার মৃত্যুতে আবদুল্লাহ্ তাহার স্থলাভিষিক্ত বলিয়া মনে করিয়া লইয়া সে আবদুল্লাহর কদমবুসি কবিরার জন্য নত মস্তকে হাত বাড়াইয়াছিল। কিন্তু আবদুল্লাহ্ পা টানিয়া লওয়ায় সে উহা স্পর্শ করিতে পাইল না; তাহার মনে হইল, বেহেশতের দুয়ারের চাবি তাহার হাতের কাছ দিয়া সরিয়া গেল! বড়ই মর্মপীড়া পাইয়া রুদ্ধকণ্ঠে কাসেম কহিতে লাগিল, আমাদের কি পায়ে ঠেললেন, হুজুর? আমরা আপনাদের কত পুরুষের মুরীদ! আপনার কেবলা সাহেব তার এই গোলামের উপর বড়ই মেহেরবান ছিলেন; আপনি আমাদের পায়ে না রাখিলে কী উপায় হবে হুজুর!
কাসেমের মানসিক অবস্থা উপলব্ধি করিয়া আবদুল্লাহ বড়ই অপ্রস্তুত হইয়া গেল। চিরদিনের সংস্কার-বশে যে ব্যক্তি তাহাকে পূর্ব হইতেই পীরের পদে প্রতিষ্ঠিত করিয়া রাখিয়াছে, এবং আজ সরল বিশ্বাসে প্রাণের ঐকান্তিক ভক্তি ও শ্রদ্ধা অঞ্জলি ভরিয়া নিবেদন করিবার জন্য উন্মুখ হইয়া দাঁড়াইয়া আছে, আবদুল্লাহর এই অপ্রত্যাশিত প্রত্যাখ্যান যে সে ব্যক্তির প্রাণে গুরুতর আঘাত দিবে ইহা আর বিচিত্র কী! কিন্তু উপায় নাই। এ আঘাত অনেককেই দিতে হইবে, এবং অনেকবার তাহাকে এইরূপ অপ্রীতিকর অবস্থার সম্মুখীন হইতে হইবে।
আবদুল্লাহ্ কহিল, অমন কথা বলবেন না, গোলদার সাহেব। আমার বাপ-দাদা সকলেই পীর ছিলেন মানি, কিন্তু আমি তো তাদের মতো পীর হবার যোগ্য হই নি। ও কাজটা আমার দ্বারা কোনোমতেই হবে না। তা ছাড়া আপনি বৃদ্ধ, সুতরাং আমার মুরব্বি; এক্ষেত্রে আমারই উচিত আপনার কদমবুসি করা।
কাসেম শিহরিয়া উঠিয়া দাঁতে জিভ কাটিয়া কহিল, আরে বাপরে বাপ! এমন কথা বলে আমাকে গোনাহগার করবেন না, হুজুর! যে বংশে খোদা আপনাকে পয়দা করেছেন, তার এক বিন্দু রক্ত যার গায়ে আছে, তিনিই আমাদের পীর, আমাদের মাথার মণি! আপনাদের পায়ের একটুখানি ধুলো পেলেই আমাদের আখেরাতের পথ খোলাসা হয়ে যায়, হুজুর!
আবদুল্লাহ্ একটুখানি হাসিয়া কহিল, খোদা না করুন যেন আখেরাতের পথ খোলাসা করবার জন্যে কাউকে আমার মতো লোকের পায়ের ধুলো নিতে হয়! তা যাকগে, এখন আমি যে এতটা পথ হেঁটে হয়রান হয়ে এলাম, আমাকে একটু বিশ্রাম করতে দিতে হবে, সে কথা কি ভুলে গেলেন গোলদার সাহেব?
কাসেমের চৈতন্য হইল। তাই তো! এতক্ষণ সে কথাটা যে তাহার খেয়ালেই আসে। নাই। তখনই, ওরে বিছানাটা পেতে দে, পানি আন, তেল আন, গোসলের যোগাড় কর ইত্যাকার শোরগোল পড়িয়া গেল।
আবদুল্লাহ যখন মুরশিদের প্রাপ্য ভক্তি-নিদর্শনগুলি গ্রহণ করিয়া কাসেমের মনের বাসনা পূর্ণ করিতে অস্বীকার করিল, তখন সে অন্তত মেহমানদারি বাবদে সে ত্রুটি ষোল আনা সংশোধন করিয়া লইতে চেষ্টা করিল। সময়াভাবে এ-বেলা কেবল মোরগের গোশত এবং মুগের ডাল প্রভৃতির দ্বারা কোনো প্রকারে মেহমানের মান-রক্ষা হইল বটে, কিন্তু রাতের জন্যে বড় এক জোড়া খাসির এবং সেই উপলক্ষে গ্রামের প্রধান ব্যক্তিগণকেও দাওয়াদ করিবার বন্দোবস্ত হইয়া গেল।
এদিকে বেলা প্রায় তিন প্রহরের সময় আহারাদি সম্পন্ন করিয়া যখন আবদুল্লাহ্ কাসেম গোলদারকে ডাকিয়া কহিল যে, আর বিলম্ব করিলে চলিবে না, তাহাকে এখনই রওয়ানা হইতে হইবে, নহিলে সন্ধ্যার পূর্বে একবালপুরে পৌঁছিতে পারিবে না, তখন কাসেমের মাথায় যেন আকাশ ভাঙিয়া পড়িল। সে হাত দুটি জোড় করিয়া এমনই কাতর মিনতিপূর্ণ দৃষ্টি তাঁহার মুখের উপর স্থাপন করিল যে, বেচারা বুড়া মানুষের মনে দ্বিতীয়বার দুঃখ দিতে আবদুল্লাহর মন সরিল না। সুতরাং সে সেখানেই সেদিনকার মতো রাত্রিবাস করিতে রাজি হইয়া গেল। আনন্দে উৎফুল্ল হইয়া কাসেম তৎক্ষণাৎ কোমর বাঁধিয়া যথারীতি আয়োজনে লাগিয়া পড়িল।
সারাটা বৈকাল এবং রাত্রি এক প্রহর ধরিয়া লোকজনের আনাগোনা, চিৎকার, বালক বালিকাগণের গণ্ডগোল এবং ডেকচি, কাফগীরের ঘনসংঘাতে গোলদার-বাড়ি মুখরিত হইতে লাগিল। এই বিরাট ব্যাপার দেখিয়া আবদুল্লাহ ভাবিতে লাগিল, মুসলমান সমাজে পীর মুরশিদের সম্ভ্রম ও মর্যাদা কত উচ্চ! গোলদারেরা না হয় সঙ্গতিপন্ন গৃহস্থ; ইহাদের পক্ষে মুরশিদের অভ্যর্থনার জন্য অম্লান বদনে অর্থ ব্যয় করা অসম্ভব না হইতে পারে। কিন্তু নিতান্ত দরিদ্র যে, সে-ও তাহার বহু যত্নপালিত খাসি-মুরগির মায়া গৃহাগত মুরশিদের সেবায় উৎসর্গ করিয়া এবং মহাজনের নিকট হইতে উচ্চ হারের সুদে গৃহীত ঋণের শেষ টাকাটি সালামী স্বরূপ তাহার চরণপ্রান্তে ফেলিয়া দিয়া বেহেশতের পাথেয় সঞ্চয় হইল ভাবিয়া আপনাকে ধন্য মনে করে।