- বইয়ের নামঃ আবদুল্লাহ
- লেখকের নামঃ কাজী ইমদাদুল হক
- বিভাগসমূহঃ উপন্যাস
ভূমিকা (ডক্টর বিশ্বজিৎ ঘোষ)
ভূমিকা
উনিশ শতকের প্রারম্ভেই কলকাতাকেন্দ্রিক হিন্দু মধ্যবিত্ত শ্রেণীর বিকাশ ঘটলেও ঐতিহাসিক-সামাজিক-রাজনৈতিক কারণে প্রায় শতবর্ষ পরে জন্ম নেয় ঢাকাকেন্দ্রিক নবজাগ্রত মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণী। শতবর্ষের পশ্চাৎপদতার অলঙ্ঘ্য দেয়াল, রক্তস্রোতে জমে থাকা সংস্কারের মোহন-পুষ্ট প্রলেপ, ধর্মীয় গোঁড়ামি আর কারণ-অকারণ সম্প্রদায়-বৈরী– সবকিছু মিলে বাঙালি মুসলিমমানস তখন পাড়ি দিচ্ছে এক ঊর্মিল ক্রান্তিলগ্ন। শতাব্দীর বেদনাময় যুগ-প্রতিবেশ অতিক্রমণের অভিলাষে নবজাগ্রত মুসলিম-মনীষা তখন হয়ে ওঠে সংস্কারমুখী, ছড়িয়ে দিতে চায় নতুন যুগের নতুন আলো; বিশ শতকের শুরুতেই তারা নতুন স্বপ্নের সম্ভাবনায় হয়ে ওঠে সৃষ্টিচঞ্চল। কিন্তু শতাব্দী-পরম্পরায় প্রসারিত সামন্ত মূল্যবোধের সঙ্গে প্রাথমিক প্রতিক্রিয়াতেই বিরোধ বাধে নবজাগ্রত এই শক্তির, রক্তাক্ত হয়ে ওঠে বুর্জোয়া মানবতাবাদে প্রত্যয়ী মধ্যশ্রেণীর সচেতন-সত্তা। বিশ শতকের সূচনালগ্নে যন্ত্রণাজর্জর এই যুগ-প্রতিবেশে বাংলা সাহিত্য-ক্ষেত্রে আবির্ভূত হন মুক্তচিত্ত-দ্রোহী এক আধুনিক শিল্পী, নাম তাঁর খান বাহাদুর কাজী ইমদাদুল হক (১৮৮২-১৯২৬)।
মুসলিম সাহিত্যিকদের মধ্যে ইমদাদুল হক হচ্ছেন সেই শিল্পী, যিনি শিল্প-উপাদান সংগ্রহে প্রথম মনোযোগী হলেন সমকালের প্রতি। তিনি ছিলেন সংস্কারমুক্ত, উদার মানবতাবাদী, মননশীল এবং যুক্তিবাদী শিল্পদৃষ্টিসম্পন্ন ঔপন্যাসিক। কুসংস্কারাচ্ছন্ন প্রথালালিত সামন্ত-মূল্যবোধে স্নিগ্ধ মুসলিম সমাজ-অঙ্গনে বাসন্তি হাওয়ার প্রত্যাশায় ইমদাদুল হক সাহিত্যক্ষেত্রে দ্রোহীসত্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছিলেন। তবু তিনি বিদ্রোহী নন, সমাজ ভাঙার ডাক নেই তার কর্মে-বরং মুসলিম সমাজের বিবিধ খণ্ডচিত্র আর গ্লানির অঙ্গন উপস্থাপন করেই তিনি তৃপ্ত থাকতে চেয়েছেন। বলা যেতে পারে, ইমদাদুল হক যেন অনেকটা মুসলিমসমাজের শরৎচন্দ্র (১৮৭৬-১৯৩৮), শরৎচন্দ্র পল্লী-সমাজ-এ (১৯১৬) যা করেছেন তাই যেন ধরেছেন ইমদাদুল হক তাঁর উপন্যাসে–অবশ্যই স্ব-সমাজের পটভূমিতে।
মহান শিক্ষাব্রতী ইমদাদুল হকের শিল্পিমানসের প্রধান শক্তি তাঁর প্রখর সমাজবীক্ষণ ক্ষমতা এবং এই প্রধান শক্তিই, আমাদের বিবেচনায়, তার শিল্পিসত্তার প্রধান দুর্বলতা। সমাজবীক্ষণ-সূত্রে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষ দেখে তিনি ব্যথিত হয়েছেন এবং সাহিত্যক্ষেত্রে এই বিদ্বেষের প্রতিফলনে তিনি হয়েছেন ক্ষুব্ধ। তিনি মুক্তচিত্তেই প্রত্যাশী ছিলেন ভারতের মহামিলনে– শিল্পিমানসের এই প্রত্যাশাই তার সকল সাহিত্যকর্মের মৌল প্রেরণা। তার স্বপ্ন আর প্রত্যাশা-প্রার্থনা কেমন ছিল, তা নিজেই তিনি লিখে গেছেন ১৩১০ সালের বৈশাখ সংখ্যা ভারতী পত্রিকায় প্রকাশিত হিন্দু-মুসলমান ও বঙ্গ-সাহিত্য নামক প্রবন্ধে এবং সেখান থেকেই এক দীপ্র এলাকা :
হিন্দুগণ মুসলমানের হৃদয়ে আঘাত প্রদান করিয়া যে বিরোধ সৃষ্টি করিয়া রাখিয়াছেন, তাহার উপর আবার মুসলমানগণ যদি হিন্দুর অন্তরে ক্ষোভদান করিয়া বিরোধের উপর বিরোধ চাপাইতে বসেন, তাহা হইলে আমাদের ইউনাইটেড ইন্ডিয়ার স্বপ্ন কস্মিনকালেও সফল হইবে না, কিন্তু হিন্দু সুলেখকগণ যদি মুসলমান-বিদ্বেষভাব সাহিত্যে এত পরিস্ফুট করিয়া তুলিয়া ইংরাজের ফরাসী এবং আইরিশ-বিদ্বেষের দৃষ্টান্ত অনুকরণ না করিতেন তাহা হইলে হিন্দু-মুসলমানকে আজ একই গৃহে আবদ্ধ বৈরীভাবাপন্ন দুই সহোদর ভ্রাতার ন্যায় পরস্পর কুণ্ঠিত ও সঙ্কুচিত হইয়া বাস করিতে হইত না।
০২.
চুয়াল্লিশ বছরের কর্মচঞ্চল জীবনে ইমদাদুল হকের প্রধান কীর্তি আবদুল্লাহ্ (১৯৩৩) উপন্যাস।২ একটিমাত্র উপন্যাস লিখে ইমদাদুল হক বাংলা সাহিত্যে রেখে গেছেন তার স্বতন্ত্র প্রতিভার স্বাক্ষর। আবদুল্লাহ উপন্যাস বিংশ শতাব্দীর প্রথম দুই দশকের সময়সীমায় প্রবাহিত মুসলিম জীবনবিশ্বাস এবং জীবন-যন্ত্রণার শিল্পিত ভাষ্য। একটি বিশেষ যুগসত্যকে ধারণ করে রচিত হলেও আবদুল্লাহ্ স্ব-কালের সীমা পেরিয়ে অভিষিক্ত হয়েছে কালোত্তীর্ণ শিল্পের মর্যাদায়। যে বিষয়পুঞ্জকে কেন্দ্র করে লেখা হয়েছে আবদুল্লাহ্ তা এখনো আছে আমাদের সমাজে, হয়তো কমেছে তার মাত্রা এবং আসবে এমন একদিন যেদিন বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিকে মুসলিমজীবন কেমন ছিল, তার অস্তিত্ব খুঁজবো ইমদাদুল হকের আবদুল্লাহ্-র পাতায়–সেদিন আবদুল্লাহ্ বোধকরি, শিল্প থাকবে না, হবে ইতিহাস এবং সে-সূত্রেই আমরা বলছি, আবদুল্লাহ্ যতটা না শিল্প, তার চেয়ে বড় কথা এ-হচ্ছে সমাজচিত্র, খালি চোখে দেখা পুঙ্খানুপুঙ্খ সমাজবাস্তবতা।
আবদুল্লাহ্ উপন্যাসে চিত্রিত হয়েছে গ্রামীণ মুসলিমসমাজের পীরভক্তি, ধর্মীয় কুসংস্কার, পর্দাপ্রথা, আশরাফ-আতরাফ বৈষম্য, হীন স্বার্থপরতা, সম্প্রদায়বিদ্বেষ ইত্যাদির বিরুদ্ধে বুর্জোয়া মানবতাবাদী প্রতিবাদ। মধ্যবিত্তের বিকাশের ফলে মুসলিমসমাজের ভিত্ কিভাবে নড়ে উঠেছে তার চিত্র আছে, আছে গ্রামীণ সমাজের বহুমাত্রিক জটিলতা ও বিরোধ; তবু স্রষ্টার ধর্মনিরপেক্ষ উদার মানবতাবাদী দর্শনই আবদুল্লাহ্ উপন্যাসের মৌল-অভিজ্ঞান। ইমদাদুল হক স্বপ্ন দেখেছেন মানব-মৈত্রীর, ঘৃণা করেছেন সম্প্রদায়-বিদ্বেষী মানসিকতাকে মুসলিম জীবনচিত্রণ-সূত্রে এ-কথাই উচ্চারিত হয়েছে উপন্যাসে। এ-প্রসঙ্গে স্মরণীয় আবদুল্লাহ্ উপন্যাস সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের অভিমত