সকালে উঠে ইন্দুবালা দেখেন লছমী নিজে উনুন ধরিয়েছে। আটার বড় বড় গোল গোল লেচি বানিয়েছে। তার মধ্যে ছাতু দিয়ে উনুনের আঁচে সেঁকছে। দিশি টমেটো সেদ্ধ করেছে। তার মধ্যে ধনে পাতা, কাঁচা লঙ্কা এইসব দিয়ে একটা চাটনি করেছে। “তোকে আমার কমলা গাঁওয়ের একটা খানা খাওয়াবো মা”। ইন্দুবালা চেখে দেখেছেন অন্যরকম স্বাদ তার। শুকনো পিঠে যদি এইভাবে করা যেত? ছাতুর বদলে নারকেলের পুর। “কী বলে রে এই খাবারটাকে লছমী?” লছমী জানতে চায় “আগে বলো ভালো লাগছে কি? আমার মরদ এক সাথে কত খেয়ে নিতো। বাচ্চারা আমার এই লিট্টি খাওয়ার জন্য বসে থাকে মা। আর চাটনি? পসন্দ হয়নি?” খুব ভালো লেগেছে ইন্দুবালার। “লছমী আমি তোর এই কমলা গাঁওয়ের চাটনিটা নিয়ে নিলাম রে। লিট্টি তো আর তোর মতো বানাতে পারবো না। চাটনিটা চেষ্টা করে দেখতে পারি”। সেদিন বিকেলে বাস ট্রেন চলার পরে লছমী চলে গিয়েছিল। কিন্তু গোটা বাড়িতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রেখে গেল ইন্দুবালার একটা না দেখা কমলা গ্রামকে। তার পাশ দিয়ে তিরতির করে বয়ে চলা কমলা নদীকে। নদীর ধারে ছট পুজো, হোলিকে।
আজ যেন মনে হচ্ছে হেতালের মায়ের দোকানটা বড্ড বেশি দূরে। ধনঞ্জয়কে সঙ্গে আনতে পারলে ভালো হতো। রাগ করে এইভাবে ছুটে বেরিয়ে আসা মোটেই উচিত হয়নি ইন্দুবালার। যদি রাস্তায় পড়ে যান তাহলে একটা কাণ্ড ঘটবে। ঠিক যেমন হয়েছিল লছমীর। বুঝতে পারেনি ট্রেন আসছে। মাথায় ছিল মাছ ভর্তি ঝুড়ি। তাড়া ছিল বাজারে আসার। সেদিন আবার কালেক্টার অফিসের বড়বাবু বলেছিলেন কচুবাটা খেতে আসবেন। লছমীর ঝুড়িতে ছিল মাছ। কাঁধের বস্তার বোঁচকায় ছিল বড় কচু, দিশি ছোট টমেটো, খুব ঝাল লঙ্কা, ধনে পাতা। অনেক ভোরে, কুয়াশার মধ্যে অন্যমনস্ক লছমী বুঝতে পারেনি ট্রেন এসে পড়েছে খুব কাছেই। পার হতে পারেনি লাইন। ছিটকে পড়েছিল মাছের ঝুড়ি। কাঁধের বস্তা। দেহ থেকে আলাদা হয়ে গিয়েছিল ওই হাসিখুশি মুখটা। অনেক বেলায় খবরটা এসেছিল। ইন্দুবালা তখন কালেক্টার অফিসের লোকজন নিয়ে হিমসিম খাচ্ছেন। ভেবেছিলেন লছমী আসেনি হয়তো শরীর খারাপ করেছে। কিন্তু মনে মনে দুশ্চিন্তাও করেছেন এমন কথার খেলাপ তো লছমী করে না। সব ভাবনা চিন্তা চাপা দেওয়ার জন্য ইন্দুবালা আরও রান্নার পদ বাড়িয়ে নিয়েছেন ততক্ষণে। কচুবাটার জায়গায় ঢুকে পড়েছে ছ্যাঁচড়া। সবাই যখন গরম গরম ভাত দিয়ে খাবে এতসব রান্না ঠিক সেই সময়ে রান্নাঘরের পেছনের দরজা দিয়ে ঢুকলো দয়ারাম। লছমীর সাথেই আসতো সে। তার পাশে বসেই মাছ বিক্রি করতো। দুজনের যত ঝগড়া ছিল তত ভাব। শুকনো মুখে দয়ারামকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ছাঁক করে উঠেছিল বুক। “কী হয়েছে রে দয়ারাম? ওরকম শুকনো মুখ কেন তোর?” দয়ারাম বসে পড়েছিল দোরগোড়ায় মাথায় হাত দিয়ে। ডুকরে ডুকরে কেঁদে বলেছিল পুরো ঘটনাটা। চুপ করে শুনেছিলেন ইন্দুবালা। নিজের মনের ভেতরের তোলপাড় কাউকে বুঝতে দেননি তিনি। নিজের সব সময় ভেবে এসেছেন এই হোটেলের যদি কেউ অংশীদার থেকে থাকে তাহলে সে হলো লছমী। তার সেই প্রথম দিনের টাকায় হোটেল শুরু না হলে কোনদিন ইন্দুবালা মাথা তুলে দাঁড়াতে পারতেন না। শান্তভাবে সবাইকে খাইয়ে, স্নান করে নতুন কাপড় পরলেন ইন্দুবালা। দয়ারামকে নিয়ে নিজে গেলেন মর্গে। সেখানে একবার শেষ দেখা দেখবেন ভাতে কাপড়ে তাঁকে বাঁচিয়ে যাওয়া বিহারের সেই কোন অজ কমলা গ্রামের মেয়েটিকে। যার বাবা মা বিয়ে দেওয়ার নামে পণ দিয়ে বেচে দিয়েছিল কোনো এক নেশাখোর মানুষের কাছে। লছমী চুপ করে শুয়ে ছিল মর্গের মেঝেতে তার হাসি হাসি মুখ নিয়ে। শুধু গলার কাছে। ছিল একটা চওড়া সেলাই। বসে পড়েছিলেন ইন্দুবালা ঠিক লছমীর পাশে মর্গের মেঝেতেই। মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছিলেন মৃত সখীর। “এমন তো কথা ছিল না রে। উনুন ধরিয়ে বসেছিলাম তোর জন্যে। তুই এলি না। কথা রাখলি না”। এত শুকনো চোখেও জল পড়ে ইন্দুবালার। ভেপসে ওঠা মর্গটাও যেন শোকের সজীবতা পায়।
লছমীকে দেখেই কাজ শেষ হয়ে যায়নি ইন্দুবালার। পুলিশের কাছে যে ফর্ম থাকে অশনাক্ত বডির সনাক্তকরণের সেইসব কিছু ফর্মালিটি করতে হল তাঁকেই। বাজারের একগাদা গরীব গুর্বো লোকের সাথে ভদ্রঘরের এক বিধবাকে দেখে পুলিশের লোকজন একটু অবাক হয়েছিল বটে তবে বিস্তারিত প্রশ্ন করার অবকাশ ছাড়েনি। লছমী যে তাঁর আত্মীয় হয় পুলিশের কাছে বলেছিলেন ইন্দুবালা। “ঠিক কি ধরনের আত্মীয় যদি একটু বলেন দিদি?” জানতে চেয়েছিল লোকাল থানার ওসি বিষ্ণুপদ হাজরা। ইন্দুবালা বলেছিলেন “বোন..”। ঘুরিয়ে জানতে চেয়েছিল ওসি, “একজন বিহারী বাঙালির বোন?” ইন্দুবালা সরাসরি তাকিয়ে বলেছিলেন “কেন হতে পারে না? আমার আপনার রক্তের হিসেব কার কাছে লেখা আছে স্যার? রক্তের আত্মীয়তাই কি সব?” ওসি কথা এগোয়নি। এমনিতে বেশি মাল কড়ি পাওয়া যাবে না এদের কাছে। ফর্মে সই করে ছেড়ে দিয়েছিল। বেরিয়ে আসার সময় ইন্দুবালা দেখেছিলেন দরজার কাছে পড়ে আছে কচুটা, ঝুড়িটা। আইডেন্টিফিকেশানের জন্য নিয়ে আসা হয়েছে। কাউকে কিছু না বলে কচু আর ঝুড়ি দুটোই নিয়ে এসেছিলেন ইন্দুবালা। যিনি কোনোদিন তাঁর স্বামীর একটা ছবি বাড়িতে রাখেননি তিনি তাঁর সখীর শেষ চিহ্নটুকু নষ্ট হতে দেননি।