কলকাতা স্টেশনে যাত্রীদের আনন্দের আতিশয্যের ফাঁকে সেদিন ট্রেনে ওঠার আগে কেউ কেউ লক্ষ্য করলেন এক সত্তর পেরোনো মহিলাকে। যার গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে করুণাধারা। যিনি চুপ করে বসে আছেন দেশ নামের এমন এক স্বপ্ন নিয়ে, যে দেশে তাঁর জন্যে আজ আর অপেক্ষা করে থাকবার কেউ নেই। মনে মনে আরও একবার প্রতিজ্ঞা করলেন ইন্দুবালা। ভাতের হোটেল ছেড়ে তিনি কোত্থাও কোনোদিন যাননি। আজও যাবেন না। শত প্রলোভনেও না। হনহন করে হাঁটতে থাকেন তিনি ওভার ব্রিজ দিয়ে। এক্ষুনি তাঁর মনে পড়ে গেছে আজকের মেনুতে আম-কই এর কথাটা বোর্ডে লিখতে ভুলে গেছেন। ধনঞ্জয় শুধু জানে এই একটা পদ খেতেই আজ ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের সামনে লাইন পড়বে। কই মাছের মাখো মাখো ঝোল থেকে সুবাস উঠবে আম তেলের।
৫. মালপোয়া
৫. মালপোয়া
ভোর থেকে ঝিরঝিরে বৃষ্টি শুরু হয়েছিল। ঘুম ভেঙে গিয়েছিল তার অনেক আগেই। অন্ধকার ঘরটায় শুয়ে বৃষ্টির আওয়াজ শুনছিলেন ইন্দুবালা। অল্প অল্প বাতাসে দুলছিল জানলার হালকা পর্দাগুলো। তার ফাঁক দিয়ে উঁকি মারছিল একটু একটু করে ফর্সা হতে থাকা মেঘলা আকাশ। একতলায় ভাতের হোটেলের ওপরে তাঁর এই ঘরটা ছোট্ট হলেও বেশ খোলামেলা। অন্তত এই বাড়ির অন্যান্য ঘরগুলোর থেকে তো বটেই। ঘরের চারিদিক বরাবর বেশ কয়েকটা জানলা। সামনের দিকে এগিয়ে গেলে ছেনু মিত্তির লেন। হরেক মানুষ, গাড়ি ঘোড়ার যাতায়াত, সার সার বাড়ি। আর পেছন দিকটা শাশুড়ির আমলের ছোট্ট বাগান। সিঁড়িঙ্গে নারকেলগাছ। উঠোনের আমগাছের ডালপালা আরও কয়েকটা জানলায় ছড়ানো ছিটানো। এই ঘরটা আসলে ছিল ইন্দুবালার স্বামী মাস্টার রতলনাল মল্লিকের আমোদের জায়গা। তিনি তাঁর ইয়ার বন্ধুদের ডেকে নিয়ে এসে এই ঘরেই তুলতেন। দিন রাত তাস পেটা চলতো। তার সাথে গেলাসের পর গেলাস হুইস্কি আর সোডা। ঘরখানায় ঢুকলে তখন মনে হতো কেউ যেন সক্কালের আঁচ ধরিয়েছে। ঝাঁট দিয়ে জড়ো হতো রাশিকৃত পোড়া সিগারেট, বিড়ি, আরও কত কী। শাশুড়ি উঠতে বসতে খোঁটা দিতো বউয়ের গতর নিয়ে। যে গতরে তাঁর বাহিরমুখো ছেলে অন্দরে মন বসাতে পারলো না। যে গতর দেখে তিনি ভিসা পাসপোর্ট করে ওপার বাংলা থেকে ছেলের জন্য বাঙাল বউ নিয়ে এলেন। অথচ যে গতর বিলিয়ে সংসারে নাতি নাতনির অভাব হলো না মোটেও। তিন তিনটে সন্তানকে রেখে মাস্টার রতলনাল মল্লিক যখন ইহ জীবনের মায়া ত্যাগ করলেন তখন ইন্দুবালা ভেতরের ঘর থেকে বাইরের এই ঘরে এসে থাকতে শুরু করলেন। শুধু কি অনেক আলো, হাওয়া, বাতাসের জন্য? না, তা মোটেই না। এই ঘরে থাকলে তিনি নীচের হোটেলের রান্নাঘর থেকে ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের উপস্থিতি টের পেতেন। সিঁড়ির মুখ থেকে এই ঘরের দিকে নজর রাখা যেত খুব সহজে। আর এই ঘরটায় এলেই যেন ইন্দুবালার কলাপোতার বাড়ির দাওয়াখানা মনে পড়ে যেত। চারিদিকে সবুজের চাঁদোয়া।
ইন্দুবালা পাশ ফিরলেন। এই এত বয়সেও স্মৃতিগুলো কেন এলোমেলো হয়ে যায়? ভুলেও তো যেতে পারে মানুষ অনেক কিছু? অনেকে ভুলেও যায়। শুনেছেন তিনি। এমনকি নিজে কে ছিল। নাম কী। বাড়ির লোকজন পর্যন্ত সবাইকে ভুলে যায়। কিছু নাকি আর মনে থাকে না রোগটা হলে। চারপাশটাকে তখন কি আরও নতুন লাগে? পুনর্জন্মের মতো? কে জানে? আয়নার সামনে এই যে নিজেকে দেখে না চেনার বিড়ম্বনা। কিংবা নতুন আমিকে চিনে নেওয়া। সেটা কি আরও যন্ত্রণাদায়ক নয়? হয়তো। কিন্তু প্রতিদিনের, প্রতিক্ষণের এই স্মৃতির বোঝা টানা আরও কষ্টকর ইন্দুবালার কাছে। নিয়তিকে দোহাই দেন ইন্দুবালা। হয় ভুলিয়ে দাও। না হলে ভুলিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করে দাও। অদৃষ্টকে সাত গাল পাড়লেও অনেক কিছু ভোলা হয় না ইন্দুবালার। ভাগ্যিস ভোলা হয় না। তাই তো আনাজের চুবড়ি থেকে, সূঁচ সুতোর কৌটো থেকে, ভাতের হাঁড়ির সুবাস থেকে বেরিয়ে আসে কত কত গল্প। ইন্দুবালা চোখ বন্ধ করে আবার একটু ঘুমোনোর চেষ্টা করলেন। ঠাম্মা সন্ধ্যেবেলায় আফিম খেতো। ছোটো ছোটো কালো কালো গুলি করা থাকতো পিতলের কৌটোতে। বাবা খুলনা শহরের বড় এক আড়তদারের কাছ থেকে নিয়ে আসতেন। ফুরিয়ে আসতে থাকলেই ঠাম্মার মাথা যেত খারাপ হয়ে। একটানা আবদার চলতো তার। ধুয়ো টেনে টেনে ঠাম্মা বলে চলতো, “ও ব্রজ, নিয়ে আয় না বাবা। শেষ হয়ে গেল যে গুলি”। সেই কাতর চাহনি এখনও যেন মনে পড়ে ইন্দুবালার। ঠিক মরে যাওয়া মানুষের চাহনির সাথে তার কি কোনো মিল ছিল? ছ্যাঁৎ করে ওঠে বুকটা। শাশুড়ির কথা মনে পড়ে। স্বামীর কথাও। মৃত মানুষের চাহনি ইন্দুবালাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায়। ঘিরে ধরে এক বৃষ্টি ভেজা সকালে।
মুকুলে ভরা আম গাছের তলায় শোয়ানো হয়েছিল দাদুকে। বসন্তের আগমনের আগাম জানান দিচ্ছিল দু একটা কোকিল দূরের কোনো গাছ গাছালির শাখায় বসে। ইন্দুবালা তখন খুব ছোটো। কিছুক্ষণ আগে ঠাম্মা ভাজছিলেন দাওয়া আলো করে নতুন গুড়ের মালপোয়া। গোটা গ্রামে যেন ছড়িয়ে পড়েছিল গন্ধ। তেলের ছাঁক ছুক আওয়াজে উমনো ঝুমনোর পিঠে খাওয়ার গল্পটা আগাগোড়া বলে চলেছিল ঠাম্মা। হাঁ করে বসে শুনছিল ছোট্ট ইন্দুবালা। দাদু স্নান করতে যাচ্ছিল বোসদের পুকুরে। বাবা গিয়েছিল ধান বিক্রি করতে হাটে। মা ছিল শোওয়া। ভাই তখন পেটে। দাদুর ইচ্ছে হয়েছিল অসময়ে মালপোয়া খাওয়ার। মুখ ফুটে যে মানুষ কিছু চায় না কোনোদিন, সেই মানুষ যখন মালপোয়া খেতে চেয়েছে ইন্দুবালার ঠাম্মার আনন্দ আর গোপন থাকে না। নিজেই গম পিষিয়ে নতুন আটা বের করেছেন জাঁতি ঘুরিয়ে। চাল কুটেছেন ঢেকিতে। বেটেছেন শিলনোড়ায় মিহি করে। নতুন গুড়ের হালকা একটা রস করেছেন। কয়েকদিন খুব ব্যস্ত থেকেছেন নানা তরিজুতের ছোটোখাটো উপকরণ নিয়ে। আর ছোট্ট ইন্দুবালা ঠাম্মার আঁচল ঘিরে, কাপড় জড়িয়ে, কোলে শুয়ে সেই আখ্যানের অংশীদার হয়েছে। উমনো ঝুমনোর গল্প যখন ফুরিয়ে এসেছে, শেষ মালপোয়া যখন তেলের ওপর লাল হয়ে ফুলে উঠছে, মৌরির সুবাস যখন কলাপোতা গ্রামে ম ম করে উঠছে, দাদু স্নান সেরে এসে তুলসী প্রণাম করতে গিয়ে বসে পড়লেন দাওয়ায়। জীবনের শেষ প্রার্থনা আর তাঁর করা হলো না। একদিন কথা বন্ধ রেখে পরের দিন ভোরের সূর্য ওঠার আগে দাদু চলে গেলেন। আমতলায় শোয়ানো থাকলে তাঁর দেহ। হরিনাম সংকীর্তনের দল গোল হয়ে ঘিরে ঘিরে ইনিয়ে বিনিয়ে সুর তুললো। বাড়ি থেকে কেউ মরা কান্নার চিৎকার করলো না। ঠাম্মা বসে থাকলেন চুপ করে পাথরের মতো। বাবা কী করবে বুঝতে পারলো না। মায়ের তখন সবে প্রসব যন্ত্রণা উঠেছে। ইন্দুবালা চুপি চুপি দাওয়ার পাশে ছোট্ট বেড়া দিয়ে ঘেরা রান্নাঘরে তখন। কাঁসার রেকাবিতে চাপা দেওয়া আছে গতকালের মালপোয়া। রসে ফুলে ততক্ষণে সেগুলো টইটম্বুর। এদিক ওদিক তাকিয়ে হাতে তুলেছিল সবে ছোট্ট মেয়েটা। গ্রামের কোন এক বউ দেখে ফেলেছিল। রে রে করে উঠে এসে ধরেছিল হাত। “অশৌচের বাড়িতে খেতে আছে কোনো কিছু? ফ্যাল হাত থেকে। ফ্যাল বলছি”। ইন্দুবালা ফেলতে পারেননি সেই মালপোয়া। গোটা রাত ধরে নতুন গুড়ের রসে ভাসতে ভাসতে সেগুলো যেন ক্লান্ত হয়ে উঠেছিল। হালকা গন্ধ বেরোচ্ছিল মৌরির। এতক্ষণ যে ঠাম্মা কারো সাথে কোনো কথা বলেননি, তিনি উঠে এলেন রান্নাঘরে। খুব শান্ত অথচ কঠিন গলায় বললেন, “ছেড়ে দাও ওকে পাঁচুর মা। ওর খাওয়া মানে ওর দাদুর আত্মার শান্তি পাওয়া। আত্মা না জুড়ালে মায়া কাটবে কী করে?” গপ গপ করে গোটা তিনেক মালপোয়া খেয়ে নিয়েছিলেন ইন্দুবালা। তাঁর হাতে মুখে লেগেছিল রস। ঠাম্মা গড়িয়ে দিয়েছিলেন জল। নিজে হাতে খাইয়েছিলেন নাতনিকে। মুখ হাত ধুইয়ে, মুছিয়ে জানতে চেয়েছিলেন, “ভালো লেগেছে ইন্দু তোর?” একটা বড় হ্যায় মাথা নেড়েছিলেন ছোট্ট ইন্দুবালা। ঠিক সেই সময় আঁতুর ঘর থেকে ভেসে এসেছিল নবজাতকের কান্নার শব্দ। ঠাম্মা নাতির মুখ দেখে বলেছিলেন, “সেই ফিরে আসতে হলো তো? কোথায় যাবে আমায় ছেড়ে?” তাঁর বিশ্বাস ছিল দাদু ফিরে এসেছেন আম, জাম, কাঁঠাল, মালপোর গন্ধ বুকে নিয়ে। বাবা ফিরেছিলেন শ্মশান বন্ধুদের সাথে বিকেলেরও পরে। ততক্ষণে ঠাম্মার সাদা থান পরা হয়ে গেছে। ছোট্ট ভাইটা হাঁ করে ঘুমোচ্ছে তার কোলে। এদের কারো মৃত মুখ দেখেননি ইন্দুবালা। ভাগ্যিস সেই চরম দুর্ভাগ্য হয়নি তাঁর।