“ছাই মেখে বসে থাকলে কি মতে ঠাকরুণ, তুমি ত আর পান্না ভৈরবী লও গো, যে নোড়াকে শিব বলবে হে! যত ছাই মাখো হে, সোনার প্রতিমা সূৰ্য্য সূৰ্য্যই; তুমি বড় সুন্দর গো, শ’ শয়ে দেখেছি, তোমার মত দেখি নাই” বলিয়াই পাক দিয়া আবার সে ঘুরিয়া নিকটে আসিল। খোলামকুচি সকল গায়ে বিদ্ধ হয়। বলিল, “আমি ভাবের কথা বললাম না হে…আমি ভবের পাগল, আমি জাত চাঁড়াল, ভাব পাব কোথা গো, ভাব আকাশগাছের ফল, তবে হ্যাঁ তুমি যদি বল…কেনে গো চাঁড়াল? হাটভাতারী। খানকি মাগীর দুয়ারের মাটি যেমন সত্য হয়, পুণ্যের হয়; তেমনই হে, শ্মশান মশানের মাটিতে” বলিয়া এক মুঠা মাটি তুলিয়া মুষ্টি উন্মুক্ত করিতে করিতে বলিল, “তুমি বলবে, এই মাটিতে ভাবের কথার হরিনুট…তুমার আবার ভাবনা কি গো” ইহার পর নিজেই উত্তর করিল, সে মাগী যেমন খানকিই থাকে পুণ্য পায় না; হারে কপাল! তেমনি, আমি ভাব পাই না গো, খোল বড় ভালবাসি গো, দেখনা কেনে ভূতগুলো আমার পড়শী স্যাঙাত!” বলিয়া হাতের উপর মস্তক রাখিয়া শুইয়া একদৃষ্টে যশোবতীর প্রতি চাহিয়া রহিল।
কিছুকাল অতিবাহিত হইয়াছে, যশোবতী হৃত শক্তি ফিরিয়া পাইয়াছেন। দক্ষিণহস্তে কাজললতা মুষ্টিবদ্ধ করিয়া কহিলেন, “চাঁড়াল”–এই সম্বোধনবাক্য তাঁহার কণ্ঠবিবর হইতে ক্ষিপ্ত জন্তুর মত লম্ফ দিয়া বাহির হইল। এবং করস্থিত বলয় ছুঁড়িয়া অন্যান্য দুই একটি অলঙ্কার ঝটিতি খুলিয়া উন্মত্তের ন্যায় ছুঁড়িয়া বলিলেন, “এই নাও…ডাকাত…” তাঁহার কণ্ঠস্বর রুদ্ধ হইল।
চণ্ডাল বৈজুনাথ ইহার জন্য প্রস্তুত ছিল না, তাহার দশাসই দেহ বাঁকিয়া চুরিয়া গেল। যশোবতীর উক্ত বাক্য প্রতিধ্বনিত হইল। অলঙ্কার প্রতি দৃষ্টি নিক্ষেপ করিয়া চণ্ডাল মাটি ছাড়িয়া উঠিয়া দাঁড়াইল। তাহার মুখে ক্ষুব্ধ অসহায়তা, ক্রমে কুটির হাসি, পদ্মপত্রে জলের মত চঞ্চল। সে তাহার বাম পদখানি মৃত্তিকার উপর দিয়া সম্মুখে পশ্চাতে লইয়া যাইতে লাগিল গোরু যেমনে ক্ষুর ঘর্ষণ করে, এবং শেষ বারের মত দৃষ্টি নিক্ষেপ করত কহিল, “মর” বলিয়া দ্রুতপদে স্থান পরিত্যাগ করিয়া সে এখন আপনার আড়ায় অদৃশ্য, আর যেন তাহার ছায়াও অন্তর্হিত হইল। ইদানীং তাহার স্থানেই নিম-শূন্যতা, ভ্রমর, দিবাস্বপ্ন।
জ্যোতির্মণ্ডলের যে মনঃস্বিতা অবলীলায় শ্যামঘন পৃথিবীকে আপনার বিচিত্রতায় রাখিতে চাহিয়াছিল, উদ্বুদ্ধ করে, তাহা যেন নাই। যশোবতী ছাউনিতে চিত্রার্পিতের ন্যায়, তিনি নববধু, তিনি মিলন অভিলাষিণী তাঁহার মাংসল যৌবনকে লইয়া, যে, দূরত্বের ইঙ্গিত সকল, সাফল্যের তন্দ্রা সকলই, হিম তুষার সফেন তরঙ্গ, লাল কম্পনে অরুণাভ গিরিপ্রান্তর সকল যে খেলা করিবে, এ গীত আমন্ত্রণ তিনি শুনিয়াছিলেন। তাহারা বলিয়াছিল, আমাদের বাহু নাই তথাপি তোমাকে তড়িৎ-আলিঙ্গন করিব, আমাদের ওষ্ঠ নাই তথাপি তোমাকে চুম্বন করিব, আমরা সদেহে তোমার মধ্যে প্রবেশ করত তোমাকে আনন্দ দান করিব। কেননা আমরা নব্য, কেননা যেহেতু আমাদের কল্পনা নাই। তিনি একদা রোমাঞ্চিত হইয়া উঠিয়া সম্মুখবর্ত্তী অবকাশ দেখিলেন, আপনার অলঙ্কারগুলি ইতস্ততঃ বিক্ষিপ্ত, ক্লান্ত পতঙ্গ যেমন বা; সোনাকে অবলম্বন করিয়া কোন ঝা শ্বেত হয়! যশোবতী একইভাবে আপনার মিলন-আগ্রহকে স্পর্শ করিয়াছিলেন।
৫. চণ্ডাল সূক্ষ্ম হইতে পারিল না
চণ্ডাল সূক্ষ্ম হইতে পারিল না, আপনার ছোট আড়ায় আসিয়া, সঘন নিঃশ্বাস ফেলিল; সে মনে হয় পলাইয়া আসিয়াছে, সে মনে হয় পথ হারাইয়াছে।
বৈজুনাথ যে দুই কলস মদ আনিয়াছিল তাহার একটি হইতে নরকপালে ঢালিয়া পান করিল, পরক্ষণে নরকপালের দিকে চাহিয়া বিড় বিড় করিয়া কি যেন বা বলিল, রুক্ষ আড়ষ্ট নিঃশ্বাস কণ্ঠস্বরে পাতা পোড়ার শব্দ, যাহা শুদ্ধ ভাষায় সম্ভবত বলিয়াছিল, “হায় কার অঞ্জলিবদ্ধ হাত, তুমি হাড় হয়ে আছ। এ কপাল কাহাকে আহ্বান করে। মন কি সকল সময় উর্ধলোকে–সেখানে যায়।”
ইহার পর অঙ্গুলি দিয়া আসব গ্রহণ করত চুষিতে লাগিল। যদিও সে এ প্রশ্ন করিয়াছে, যদিও সে আপনার মধ্যে শ্রান্তিকে দর্শন করিয়াছে, আপনার অনুভব স্রোতকে তাহার নিজস্ব প্রকৃতিতেই দেখে, তবু পুনরায় ঢালিল। পান করিয়া গঙ্গার তীরে গিয়া দাঁড়াইয়া ব্যাকুল স্বরে কহিল, “মা মা গো লেমিনাথ শালাকে জরিয়ে দাও গো, আর পাপ নয় মা গো…পাপীকে উদ্ধার কর।” বলিতে বলিতে বৈজু তাহার নিজের দেহের মধ্যস্থিত এক অত্যাশ্চর্য গাম্ভীর্যের সম্মুখীন; অন্যপক্ষে হ্রদ, তুষার, বহু বহু, জলে স্থলে ঊর্ধে যাহা কিছু বাক্যের অন্তরালে অশরীরী হইতেছে, ইহারা তাহার স্বপ্নের সামগ্রী, ইহারা তাহার পথিপ্রজ্ঞার ফলক, যে সে সুখে নিদ্রা যাইতে পারিবে তাহারই এই অপরিমিত আয়োজন। অনন্তর রাগত স্বরে কহিল, “শালী”, বলিয়া কয়েক পদ ছুটিয়া আসিয়া হয়ত সংস্কার বশে, হয়ত রুষ্টকৰ্ম্মা নিয়তি তাহাকে বিড়ম্বিত করে, অগ্নিহীন চিতায় নামিয়া স্থির; ভস্মরাশি, তাহার সহসা পদাঘাতে চকিত, বিভ্রান্ত; বৈরাগ্যজননী এই চিতায় এখন সে এবং তাহার ছায়া। সে ঘোর শেষ লইয়া একা; অদূরে অসংখ্য বাক্যনিচয় নিরর্থক। এত দুর্ধর্ষ শরীর, এক ভীম উর্বরতা এখন দারুভূত; উপরের উৎকৃষ্ট প্রতিবিম্ব এবং নিকটের স্রোত সর্প-মিথুনের মত, দিব্য, সুস্থ, চিত্তহারী বন্ধনে দীপ্যমান। চিতামধ্য হইতে এ লীলাচাতুর্য দেখিয়া সে যুগপৎ বিহ্বল, চমকিত, রিক্ত। ঝটিতি আপনার বল লাভ করিয়া উন্মত্ত হইয়া হুঙ্কার দিয়া হরিধ্বনি করিল, উত্তরোত্তর তাহার কণ্ঠ উচ্চগ্রামে উচ্চগ্রামে।