সম্ভবত, রাত্র দিন যদি সত্য হয়, তাহা হইলে, সালঙ্কারা যশোবতী ইহা দেখিয়াছিলেন। উহা বৈশাখের শূন্য প্রান্তরের দ্বিপ্রহরের নভ-আগত নূতন ধূলার সূর্যমুখী ঘূর্ণি যেমত স্পন্দিত একটি দেহ বৈভব–যাহার অন্তরীক্ষে নরকপাল এবং অন্য অন্য অস্থিনিচয় এবং বহির্দেশে, পাহাড়ী গ্রামের নিরবচ্ছিন্ন অপরাহু! অবশ্য যুগপৎ যশোবতীর সমস্ত দেহমন বৈজু-আলোড়িত গঙ্গা হইতে ভগবানের পূৰ্ব্বত কণ্ঠস্বর শুনিল।
অনন্তর বৈজুনাথ গঙ্গা ত্যাগ করিয়া বিমূঢ়ভাবে সকলকে দেখিয়া বিড়ালের মতই চক্ষুদ্বয় সঙ্কীর্ণ করে এবং পরক্ষণেই এক দৌড়ে আপনার আড়ায় গিয়া রক্ষিত ঝাঁপা হইতে তরল জ্ঞানহীনতা পান করিল।
সমবেত ব্রাহ্মণগণ বৈজুনাথের ব্যবহারে যারপরনাই আশ্চৰ্য্যান্বিত; কিছুকাল অতিবাহিত হইল, অনন্তহরি কহিলেন, “ওর জন্যে ভেব না, বেটা নেশাখোর… কাঠ এসে পড়লেই সব ঠিক হবে…তুমি আর দাঁড়িও না খুড়ো।”
কৃষ্ণপ্রাণ তাঁহার কথায় সায় দেওয়াতে লক্ষ্মীনারায়ণ কালবিলম্ব আর না করিয়া আপন কন্যার কাছে। আসিলেন, যশোবতী তখনও সেইভাবে বসিয়া আছেন। পিতা কন্যাকে দেখিয়া চমকাইয়া উঠিলেন, কেননা যশোবতাঁকে অপরিমিতা কৃষ্ণবর্ণা দেখাইতেছিল; তথাপি তিনি কোনমতে অসংলগ্নভাবে অনেক। কথাই কহিলেন, “কি মা, বেশ ভাল লাগছে ত…যাক সব ভালয় ভালয় হল। মা, ভগবানকে ডাক…মন। বসছে ত মা…তিনি বল দেবেন, আমি…আমি এবার যাব।” পিতা যেন আদিমতা।
“বাবা…”
“কোন ভয় নেই, তোমার পুণ্যে মাগো–আমাদের স্বর্গ বাস হবে, মৃত্যু মরণ যদি…কেউ আগে, কেউ পরে; আবার এমনও হতে পারে” বলিয়া জি কাটিয়া কহিলেন, “সীতারাম পুনর্জীবন লাভ করতে পারে…তোমার কপাল জোর” বলিয়াই নিকটে অপেক্ষমাণ ব্রাহ্মণদের সমর্থনের আশায় তাকাইলেন।
তাঁহারা, ব্রাহ্মণেরা, ইহাতে পুঁথিগত মস্তক আন্দোলন করেন। ইহার পর তাঁহাদের মৃত্যু সম্পর্কে অসংখ্য যোগের প্রেরণা, যুবতীজনের বক্ষের বসন্তকে ভিখারী মায়াবাদে সম্মোহিত করিল; কিন্তু একথা প্রকাশ থাক, কিছু পূর্বাহে–যখন লক্ষ্মীনারায়ণ তাঁহাকে কৃষ্ণবর্ণা দেখেন, তখন তাঁহার কন্যার চতুর্থ অবস্থা আগত; ফলে, যশোবতীর কেমন এক বিশ্বাস হইয়াছিল যে তিনি নিজেই সাধক রামপ্রসাদকে বেড়া বাঁধিতে সাহায্য করিয়া থাকিবেন। এবং একারণে এখনও সৰ্ব্ব দেহে বিদ্যুৎ খেলিতেছিল। তিনি আপনার সেই অন্তরঙ্গতা লইয়া ইহাদের স্নেহ বচন শুনিতেছিলেন, এমত সময়ে তাঁহাদের বাক্যে সতীমাহাত্ম্য গৰ্জন করিয়া উঠিল–কৃষ্ণপ্রাণ যথাযথ অলঙ্কার দিয়াছিলেন।
যশোবতী কৰ্ত্তব্যবশে একদা স্বামীর প্রতি অবলোকন করিয়া ভাবিলেন, জীবন যৌবন দিয়া অমোঘকালের সহিত যুদ্ধ আর কতকাল! ঝটিতি তাঁহার সম্মুখে উদ্ভাসিত হইল জগজন-চিতচোর। নারায়ণ, শ্রীকৃষ্ণ সাক্ষাৎ পূর্ণব্রহ্ম, তাঁহার মুকুটের ময়ূর-পুচ্ছে ইহলৌকিক যোনি-চিহ্ন!
.
যশোবতীর দৃষ্টিপথে, মানস চক্ষে, কল্পনায়, সতীদাহ অনুষ্ঠান ভাসিয়া উঠিল; অনেক সতীদাহ দেখিয়াছিলেন, সুতরাং তাঁহার পক্ষে এ কল্পনা কষ্টসাধ্যের নয়। দেখিলেন, অসংলগ্ন অনেক রূপ কৰ্ম্ম ভাসিয়া উঠিল, কখন আপনার প্রায়শ্চিত্ত পিণ্ডদান কখন বা আপনার তর্পণাদি উদক ক্রিয়ার নিমিত্ত, গঙ্গা অভিমুখে ধীর মন্থর গতিতে তিনি গমনশীলা, এ গতি অতীব সুদারুণ। প্রতি পদক্ষেপে অতীত পদদলিত হইতেছে, সম্মুখে জাগ্রত অবস্থামাত্র। তিনি যেমত বা নীড়ৈকলম্পট শ্যেনপক্ষীর ন্যায়, ক্রমাগতই ধাবমান। এখন ত্রিতাপহারিণী গঙ্গায় তাঁহার সুন্দর তড়িৎ-সম্ভবা তপ্ত কাঞ্চনবর্ণ দেহের অধোভাগ নিমজ্জিত, সুখস্পর্শ হস্তের অঙ্গুলিতে কুশ অঙ্গুরীয় ইদানীং কিয়ৎ পরিমাণে আপনাকে ভেদজ্ঞানে রাখিয়াছে, দ্বিবিধবোধের মধ্যে তাঁহার চেতনা অলস। একদিক আয়ুষ্মান্–অন্যপক্ষে রথের শব্দ, শূন্যে পক্ষীরা উড্ডীয়মান।
সহসা বায়ু স্তব্ধ, আলোকরশ্মি বস্তুরূপ ধারণ করত ধ্বংসপ্রাপ্ত, দুঃখ অস্ফুট আঃ ধ্বনি সহকারে লুপ্ত হইল। আতপ-তপ্ত পদ্মের ন্যায়, পরিক্লিষ্ট উৎপলের ন্যায় ধূলামলিন স্বর্ণের ন্যায় যশোবতী, মুখমণ্ডল তুলিয়া দৃষ্টি নিক্ষেপ করত চাহিলেন, পারিপার্শ্বিক দিকসমূহে শূন্যতা মেঘসন্নিভ; কাব্যঘন কিছুকাল পূৰ্ব্বের আপনার গাত্রহর্ষে লোক চরাচর যে আবেগে স্পন্দিত হইয়াছিল, তাহারই ক্ষীণ, সূক্ষ্ম, ম্লান, ধীর, অস্পষ্ট, অল্পকম্পন তরঙ্গস্তর এখানে পরিব্যাপ্ত। পিতৃলোকগত যশোবতী! আপনাকে আহ্বান করিতে গিয়া স্বপ্নহীন; তাঁহার ওষ্ঠদ্বয় কম্পিত হইল–সঙ্গে সঙ্গে বনান্তরাল চমকিত সবুজতা ফুসিয়া উঠল, অন্তঃসত্ত্বা সর্পের গর্ভপাত হইল। শ্রাবণমেঘের কিশোর বজ্র সকল দিত্মণ্ডলে ইতস্ততঃ ছুটাছুটি করিতে লাগিল।
যশোবতী নির্বিকার, গঙ্গার শৈত্য আর নাই, কুশ অঙ্গুরীয় অজগলস্তন; গম্ভীরকণ্ঠে কহিলেন, “তুমি পিতৃলোকে গমন করিয়াছে, মদ্দত্ত সুনির্মল স্বচ্ছ জল গ্রহণ কর”, বলিতে ‘তুমি’ শব্দ উচ্চারিত হইল না, বলিলেন, “আমি পিতৃলোক গমন করিয়াছি মদ্দত্ত সুনির্মল জল গ্রহণ করি…” এসময় তাঁহার স্বরভঙ্গ, জিহ্বা কণ্ঠগত শুষ্ক হইয়াছিল, স্তন্যপানে সুতৃপ্ত ধ্বনির ন্যায় তাঁহার কণ্ঠস্বর বিশ্বসংসারে আলোড়িত হয়। ক্রমে আপনার মুখগহ্বরে সকল কিছু দান করিতে গিয়া হচেতন হইয়া গঙ্গায় পতিত হইলেন। সকলে তাঁহাকে কোনরূপে গঙ্গা হইতে উদ্ধার করিয়া এখানে আনিল। জ্ঞানের পর তাঁহার ওষ্ঠপ্রান্তে মৃদু হাস্য ছিল।