ব্যাঙ্গমি বলে, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলনে বাগমার পুরাপুরি জড়িত আছিলেন। ওই সময়ই তারা গইড়া তুলছিলেন অপূর্ব সংসদ। অস্থায়ী পূর্ববঙ্গ সরকার। সংক্ষেপে অপূর্ব সংসদ। এই সংসদের সভাপতি আছিলেন কবি সুফিয়া কামাল। সেক্রেটারি হইছিলেন বাগমার নিজে। বাংলারে স্বাধীন করতে। হইব–এই রকম চিন্তাভাবনা তারা করতে আছিলেন।
ব্যাঙ্গমা বলে, তাগো লিফলেটে আমার সোনার বাংলা গানটা ইউজ করা হইছিল। আর সেই লিফলেট লেইখা দিছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির প্রফেসর আহমদ শরীফ।
ব্যাঙ্গমি বলে, পরে বাগমার ব্যারিস্টারি পড়তে চইলা যান লন্ডন। বঙ্গবন্ধু ১৯৬৯ সালে বাংলা স্বাধীন করার লাইগা ইন্টারন্যাশনাল কানেকশনের খোঁজে লন্ডন যান। তখন শেখ সাহেবের লগে লগে আছিলেন বাগমার। শেখ সাহেবের ৬ দফার মাঝেই বাগমার বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত হওয়ার উপায় খুঁইজা পাইলেন।
ব্যাঙ্গমা বলে, এবার ব্যারিস্টার হইয়া বাগমার দ্যাশে আইছেন। ব্যারিস্টারি করেন। শেখ মুজিব তার লিডার। বঙ্গবন্ধু কইলেন, বাগমার, দ্যাশে থাকো। দ্যাশের কাজ করো। বাগমার আওয়ামী লীগের কাজে ঝাপায়া পড়লেন। ইলেকশনের কাজ। শেখ মুজিব কইলেন, শোনো, তাজউদ্দীনের বাড়ির দোতলা ভাড়া হইব। পলিটিক্যাল লিডারের বাড়ি কেউ ভাড়া নিতে চায় না। তুমি ওই বাসা ভাড়া লও। মুজিবের কথা মানেই আদেশ। বাগমার গিয়া উঠলেন তাজউদ্দীন আহমদের বাসার দোতলায়। ৭৫১ সাতমসজিদ রোড। বাগমার তাঁর বইয়ে লেখছেন, ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ পর্যন্ত বৃহত্তর ঢাকা জেলায় ছয় দফার ব্যাখ্যা ইত্যাদি বিষয় নিয়া তিনি মোট ৩০২টা জনসভা করছিলেন। একবার তাজউদ্দীনের লগে জনসভা করতে গিয়া সাত দিন পর বাড়ি ফেরেন। আইসা তাজউদ্দীনের ওয়াইফ জোহরা ভাবি ওরফে লিলির কাছ থাইকা জানতে পারেন, তাঁর স্ত্রী আতিয়া রাগ কইরা লন্ডন চইলা গেছে। রাগ ভাঙায়া তারে লন্ডন থাইকা দেশে ফিরায়া আনতে বাগমারকে নানা কসরত করতে হইছিল। আতিয়ার সাথে বাগমারের প্রেমের বিয়া। লন্ডনে ব্যারিস্টারি পড়তে গিয়া প্রেম করছেন। বঙ্গবন্ধু যখন ১৯৬৯ সালে বঙ্গবন্ধু হইয়া লন্ডন সফর করেন, শেখ হাসিনা, ওয়াজেদ মিয়া তার লগে একই হোটেলে থাকলেন, ওই সময় আতিয়া আর বাগমারের প্রেম দেইখা হাসিনা ঠাট্টা-রসিকতা করতেন, কইতেন, প্রেম অনেক দেখছি, এই রকমের প্রেম দেখি নাই।
.
দোতলায় আবদুল আজিজ বাগমার, তাঁর স্ত্রী আতিয়া নিজেদের বেডরুম ছেড়ে দিয়েছেন লিলি আর তার দুই শিশুসন্তানকে। লিলি এই বাড়িতে এসেই শাড়ি ছেড়ে সালোয়ার-কামিজ পরে নিয়েছেন। এই বাড়ির আরেকটা বেডরুমে আছেন অধ্যাপক হাবিবুর রহমান, তাঁর নতুন বিবাহিত স্ত্রী শামীম বানু। তাঁরা বেড়াতে এসেছেন, মেহমান। আরেকটা ঘরে লিলু। ক্লাস ফোরের ছাত্র। রেসিডেনসিয়ালে ভর্তি হয়েছে। বাগমারের ভাইয়ের ছেলে। এই বাসা থেকেই ক্লাস করবে, তেমনি কথা।
বাইরে প্রচণ্ড গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। শব্দের চোটে কান ফেটে যাওয়ার জোগাড়। আর দরজা-জানালার ফাঁক গলে আসছে বাইরের আলো আর আগুনের ঝলকানি। ফ্লেয়ারের আলোয় পিলখানা, মোহাম্মদপুর, সাতমসজিদ রোড ঝলসে যাচ্ছে।
লিলি কানে হাত দিয়ে শব্দের আঘাত থেকে বাঁচতে চাইছেন। ছয় বছরের ছোট্ট মিমি ঘুমাচ্ছে। শব্দে আলোয় সোহেলের ঘুম ভেঙে গেছে। সে কাঁদতে শুরু করে দিয়েছে। ভাগ্যিস রিমি, রিপি তাঁতীবাজারে। ১৭ মার্চ থেকেই তারা তাদের সেজ খালার বাসায় আছে। এমন গোলাগুলি শুরু হলো কেন? আজ রাতেই কি রোজ কিয়ামত হয়ে যাবে?
তাজউদ্দীন যে কই গেলেন? আমীর আছেন সঙ্গে। ড. কামাল আছেন। নিশ্চয়ই নিরাপদ কোনো গোপন জায়গাতেই থাকবেন। কিন্তু পৌঁছাতে পারবেন তো ঠিক জায়গায়।
৩২ নম্বর থেকেও গোলাগুলির শব্দ আসছে। মুজিব ভাই, ভাবি, ছেলেমেয়েরা ভালো আছে তো? লিলির বুক থরথরিয়ে কাঁপছে।
নিচে গাড়ির ভটভট শব্দ। গুলির ব্রহ্মাণ্ডবিদারী আওয়াজ। দানবেরা এসে গেছে। লিলি বিছানা থেকে দ্রুত নামার চেষ্টা করলেন। কিছুদিন আগে তিনি পা ভেঙে বিছানায় পড়ে ছিলেন। এখনো পা পুরো সারেনি। কিন্তু যখন নিচতলা ঘিরে ফেলেছে শত শত সৈন্য, গুলি আঘাত করছে বাড়ির দেয়ালে, তখন পায়ের ব্যথার কথা কারই-বা মনে থাকবে!
লিলি দরজা খুলে বৈঠকখানায় গেলেন। সামনে হতবিহ্বল বাগমার ও আতিয়া। বাগমার বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়ে আত্মগোপন করতে চেয়েছিলেন, আতিয়া তাকে বাড়ি ছাড়তে দেননি।
লিলি বললেন, আজরাইল এসে গেছে। আতিয়া তুমি আমার সাথে আসো। আমরা ওই ঘরে দরজা বন্ধ করে থাকি।
লিলি আর আতিয়া বেডরুমে গেলেন। দরজা বন্ধ করলেন।
নিচতলায় প্রচণ্ড শব্দ হলো। বিস্ফোরণ হলো। মিলিটারি প্রবেশ করল দরজা উড়িয়ে দিয়ে। পুরো বাড়ি আর্মিরা ঘিরে রেখেছে।
.
পাকিস্তানি মিলিটারি দরজা ভেঙে ঢুকে পড়ল বাড়ির ভেতরে। সামনে পড়ল কাজের ছেলে কিশোর বয়সী দিদার।
তারা তাকে জিজ্ঞেস করল, তাজউদ্দীন কই?
দিদারের সামনে বন্দুক উঁচিয়ে ধরে আছে আজরাইলের মতো কয়েকজন ভয়ংকরদর্শন দস্যু। বালক বলল, সাহেব, মেমসাহেব দুপুরবেলাই ছেলেমেয়ে লইয়া বাড়ি ছাইড়া চইলা গেছে গা। কই গেছে কইয়া যায় নাই।
রুমে রুমে সার্চ করা শুরু হলো। এক রুমে শুয়ে আছেন রিমি-রিপিদের নানা। তিনি বিছানায় উঠে বসেছেন। দরজায় বুটের লাথি পড়লে তা আপনা আপনি খুলে গেল।