হাসিনা কথা শেষ করার আগেই স্বপ্ন বললেন, না বাবা, আমি যাই। স্বপ্ন দৌড় ধরলেন নিজের বাড়ির দিকে।
পাগলা খিচুড়ি বসিয়েছে। চাল-ডাল সেদ্ধ হওয়ার গন্ধ আসছে। হাসিনার গলা পর্যন্ত জ্বলছে সম্ভবত অ্যাসিডিটির কারণে।
সময় যেতে চায় না। শঙ্কাকুল একেকটা হৃদয় দেয়ালের ওপারের মুকুলভরা আমগাছের পাতার মতো কাপে। তবু সময় বয়ে যায়। বিকেলে দরজায় হঠাৎ কড়া নাড়ার শব্দ।
সবার বুক ধড়াক করে ওঠে। কে এল? মিলিটারি নাকি?
রেহানা উঠলেন দরজা খুলতে। হাসিনা তাকে টেনে ধরলেন, তুই যাস না। মিলিটারি যদি আসে!
আবারও দরজায় কড়া নাড়ার শব্দ। ঠক ঠক ঠক ঠক। রেহানা একটুখানি দরজাটা ফাঁক করলেন। না, মিলিটারি না। আরেকটু খুললে দেখতে পেলেন, ওমর ভাই। কামাল ভাইয়ের বন্ধু। আপা। ওমর ভাই।
রেহানা দরজা খুললেন। ওমর ভেতরে ঢুকে কবাট বন্ধ করে ছিটকিনি লাগিয়ে দিলেন। তিনি হাঁপাচ্ছেন। ওমর ভাই কামাল ভাইয়ের ঘনিষ্ঠতম বন্ধুদের একজন। ৩২ নম্বরে বাড়ির লনে বহুদিন ক্রিকেট খেলেছেন। রেহানা তাদের বল-ব্যাট বয়ে দিয়েছেন কত!
ওমর বললেন, কামাল আমাকে পাঠাল। ও বলল, যাও, আমার বোনেরা পাগল হয়ে রাস্তায় বার হয়ে পড়বে। যাও, খবর দিয়া আসো। তাই আসলাম। ওরে বাপ রে! আসা যায়। রাস্তা অ্যাভয়েড করে বাড়িগুলোর ভিতর দিয়া আসলাম। বাইশটা ওয়াল টপকাতে হলো।
হাসিনা উঠে দাঁড়িয়েছেন। ওমরকে ঘিরে আছেন সবাই। ওয়াজেদ মিয়া, হাসিনা, রেহানা, জেলি এবং পাগলা।
হাসিনা বললেন, ওমর। আর কী খবর? আমাদের বাসার সবাই কেমন আছেন? আব্বা? মা? জামাল? রাসেল?
ওমরের পরনে একটা গ্যাবারডিনের প্যান্ট, গায়ে পোলো শার্ট, পায়ে বাটার স্যান্ডেল শু। একটুখানি শ্বাস টেনে দম নিয়ে মুখটা বিষাদে ভরে তুলে তিনি বললেন, খালুকে ওরা ধরে নিয়ে গেছে। খালাম্মা, জামাল, রাসেল গেছে বাবুদের বাড়িতে। ডাক্তার আঙ্কেলের বাড়িতে।
হাসিনা রোদন করে উঠলেন, মা তো কখনো বাড়ি থেকে বের হন না। মা বাড়ি ছাড়ল কেন? কী করেছে ওরা? আব্বার কোনো ক্ষতি হয় নাই তো?
ধরে নিয়ে গেছে। এতটুকুন জানি। খালাম্মা, জামাল, রাসেল ভালো আছে। বাড়ির অন্য সবাইকে ধরে নিয়ে গেছে।
সবাই কাঁদছে। চিৎকার করে কেঁদে উঠল পাগলা। সাহেব সাহেব, আম্মা আম্মা।
ওমর বললেন, আমি যাই। আবার কেউ দেখে ফেললে আপনাদেরও ক্ষতি হতে পারে।
ওমর চলে গেলেন।
রেহানা বললেন, আমি যাব। আমি যাব ৩২ নম্বরে। আব্বা কাল রাতে আমাকে বলে দিয়েছেন সকাল সকাল যেতে!
ওয়াজেদ বললেন, পাগলামো করিস না, রেহানা।
.
বাদুড়ের পাখায় ভর করে রাত নেমে আসতে লাগল ধানমন্ডিতে। নতুন বাকা চাঁদ উঠল ধানমন্ডি লেকের তরুসারির ওপরে। সৈন্যদের কনভয় ছুটে যাচ্ছে। কুকুর আর্তস্বরে ডাকছে। আবারও খিচুড়ি রাঁধছে পাগলা। ডাল-চালের মিশ্রণে তেল নুন-পেঁয়াজ পড়ায় একটা গন্ধও আসছে বলক ওঠা হাঁড়ি থেকে। রেহানা রেডিওর নব ঘোরাচ্ছেন। কোথাও যদি জানা যায় আব্বার খবর! হাসিনা তোশকে আধশোয়া। একটা পত্রিকা জোগাড় করে তাকে বাতাস করছেন জেলি।
৬
২৫ মার্চ রাতে তাজউদ্দীন বাসা ছেড়ে চলে গেলেন আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে, গাড়িতে। বুকটা হঠাই পাখি উড়ে যাওয়া দরজা খোলা খাঁচার মতো শূন্য মনে হতে লাগল লিলির। বাসায় রিমি, রিপিও নেই। তাঁতীবাজারে ওদের খালার বাড়িতে গেছে। ছোট্ট মিমি আর দুধের বাচ্চা ১৪ মাস বয়সী সোহেল আছে এই বাড়িতে। পিলখানার দিক থেকে তখন গুলির শব্দ আসছে। বাসাটা একেবারে সাতমসজিদ রোডের ওপরে। আর্মি নেমে গেছে। এই খবর তো জানাই। তাজউদ্দীনের খোঁজে যে আর্মিরা এই বাড়িতে আসবে, কোনো সন্দেহ নেই। তাজউদ্দীনকে না পেলে তার স্ত্রীকে ছেড়ে দেবে, তা না-ও হতে পারে। বাড়ির সামনে গাছগাছালির নিচে দাঁড়িয়ে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন জোহরা তাজউদ্দীন ওরফে লিলি। এখনই মিমি আর সোহেলকে নিয়ে মগবাজারে চলে যেতে হবে। আব্বা এই বাড়িতে আছেন। তিনি থেকে যেতে চান। থাকলে থাকবেন। আছে ভাগনে আর ভাতিজা দুজন। ওরা তো আর্মির টার্গেট হতে পারে না। যদিও কারোরই এই বাড়িতে থাকা নিরাপদ নয়। বেশি চিন্তা করতে পারছেন না লিলি। ড্রাইভারকে বললেন, গাড়ি স্টার্ট দাও।
ড্রাইভার গাড়ি রেডি করে ফেলল।
এবার তিনি বাচ্চাদের এনে গাড়িতে উঠবেন। তখনই আকাশ ভেঙে বজ্রপাতের মতো শব্দ আর আলো বর্ষিত হলো যেন। ফ্লেয়ার ছুড়ছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। আর ছুড়ছে অবিশ্রান্ত গুলি। তারা এই দিকেই ছুটে আসছে।
লিলি তাড়াতাড়ি মিমিকে এক হাতে ধরে আরেক হাতে ঘুমন্ত সোহেলকে কোলে তুলে ছুটলেন দোতলার দিকে।
লিলির আব্বা তার রুম থেকে বের হয়ে এসেছেন। গোলাগুলির শব্দের মধ্যে তিনি হতভম্ব। লিলি বললেন, বাড়িতে আর্মি আসছে। আমি দোতলায় গেলাম। আমি ভাড়াটিয়া সেজে থাকব।
দোতলার ভাড়াটে আবদুল আজিজ বাগমার। আর আছেন তাঁর স্ত্রী আতিয়া।
.
আবদুল আজিজ বাগমারের প্রসঙ্গ এলে ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি তাঁর পরিচয় নিয়ে কথা বলতে শুরু করে দেয়।
ব্যাঙ্গমা বলে, আবদুল আজিজ বাগমার তাজউদ্দীনের বাড়ির দোতলার ভাড়াইটা, এতটুকুন কইলে হইব না।
ব্যাঙ্গমি বলে, তা তো হইবই না।
ব্যাঙ্গমা বলে, বাগমার ঢাকা জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আছিলেন। তোলারাম কলেজের ছাত্র সংসদের ভিপি ইলেকটেড হইছিলেন।