উই উইল নট অ্যালাউ সাম পাওয়ার-হাঙ্গরি অ্যান্ড আনপ্যাট্রিয়াটিক পিপল টু ডেস্ট্রয় দিস কান্ট্রি অ্যান্ড প্লে উইথ দ্য ডেসটিনি অব ১২০ মিলিয়ন পিপল।
পাকিস্তান পায়েন্দাবাদ।
পাকিস্তানের জাতীয় সংগীত বাজানো হচ্ছে।
.
প্রচণ্ড গরম। একটা জানালা একটু খুলে দিলে হয়। গফুর সাহেব জানালা খুললেন। বাতাসের ঝাঁপটা এসে জানালার পর্দা দোলাতে লাগল। ছাইগন্ধ, বারুদের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধের মধ্যেও তাজউদ্দীনের ঘ্রাণেন্দ্রিয়তে এসে ধরা পড়ল আমের মুকুলের গন্ধ। মুজিব ভাইয়ের প্রিয় গান আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসিতে একটা লাইন আছে, ও মা ফাগুনে তোর আমের বনে ঘ্রাণে পাগল করে…পাক সার জমিন সাদ বাদ নিভন্ত দীপের মতো ম্লান হয়ে এল, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসির সুর আচ্ছন্ন করে ফেলল তাজউদ্দীনের সমস্ত ইন্দ্রিয়।
৫
সারা রাত ঘুমাতে পারলেন না হাসিনা। শরীরের ভেতরে সন্তানের নড়াচড়া টের পাচ্ছিলেন। শরীরটা তত ভালো নয়। তার চেয়েও বড় কথা, সমস্তটা মন। আচ্ছন্ন করে রেখেছে ভয়, শঙ্কা, দুশ্চিন্তা। রাতভরে আকাশ যেন জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে। গোলাগুলি, চিৎকারের শব্দে কানে তালা লাগার উপক্রম। গুলির ছররা এসে লাগছে বাড়ির দেয়ালে। মেঝেতে তোশক পেতে শুয়ে ছিলেন তাঁরা। শেখ হাসিনা, রেহানা, আর ওয়াজেদ মিয়া, রেহানাদের খালাতো বোন শেখ ফরিদা ওরফে জেলি। আরও আছে ৩২ নম্বরের বাড়ির পুরোনো পরিচারক ওয়াহিদার রহমান পাগলা। তারা ঘুমাতে পারেননি কেউ। আল্লাহকে ডেকেছেন। সাতমসজিদ রোডের ওপরে ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের ভাড়া বাসা। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে ওয়াজেদ মিয়া এই বাসাটা ভাড়া নিয়ে রেখেছিলেন। তাঁরই নির্দেশে ২৫ মার্চ রাতে তাঁরা এসে উঠেছেন আসবাববিহীন এই বাড়িতে। অদূরেই ইপিআর সদর, পিলখানা। গোলাগুলির অন্ত ছিল না। সকালের দিকে গোলাগুলির শব্দ কমে এল। মাইকে শোনা যেতে লাগল অবাঙালি কণ্ঠে ভাঙা ভাঙা বাংলার ঘোষণা :
সারা ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ জারি করা হইয়াছে। কেহ ঘরের বাহিরে আসিবেন না। বাহিরে কাহাকে দেখা গেলে দেখামাত্র গুলি করা হইবে। যাহাদের বাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা দেখা যাইবে, তাহাদিগের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা লওয়া হইবে।
ভোর হলো। আজান শোনা গেল না। পাখিরা ডাকল না। শুধু মাইকে এই ঘোষণা। সকাল হলো।
রেহানা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। জানালায় পর্দা নেই। তিনি বললেন, আমাদের বাসার দিক থেকে গুলির শব্দ এসেছিল। আব্বা-মা না জানি কেমন আছে? কেমন আছে রাসেল? কথা শেষ করতে পারলেন না তিনি। কান্না এসে কণ্ঠ রোধ করতে চাইছে।
জেলি বললেন, হাসুবুর জন্য যত চিন্তা। ওনার তো খাওয়া দরকার।
রেহানা বললেন, দুলাভাই, আপার তো খাওয়া দরকার। কী ব্যবস্থা করা যায়? আব্বা আমাকে সকালে বাসায় যেতে বলেছেন। আমি দেখি যাওয়া যায় কি না।
ওয়াজেদ মিয়া বললেন, রেহানা, পাগলের মতো কথা বলিস না। ওরা বলছে দেখামাত্রই গুলি। আর তুই কিনা কারফিউয়ের মধ্যে বাইরে যেতে চাস! চুপচাপ বসে থাক। পাগলা, খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা কী করা যায়?
পাগলা বলল, চাউল আছে। ডাল আছে। খিচুড়ি পাক করা যায়। এই বাড়িতে কি চুলা আছে?
ওয়াজেদ মিয়া বললেন, কেরাসিনের স্টোভ তো আছে একটা।
পাগলা খিচুড়ি বসাতে গেল। জেলি এগিয়ে গেলেন তাকে সাহায্য করতে। হাসিনাও উঠে একবার গেলেন রান্নাঘরের দিকে। পুরা বাড়িতে কোনো আসবাব নেই। বাসনকোসন নেই।
পেঁয়াজ কাটার মতো কোনো চাকু-ছুরি-বঁটিও নেই।
পাগলা দরজার পাল্লার ফাঁকে পেঁয়াজ ধরে পেঁয়াজ থেতলা করতে লাগল।
হাসিনার চোখ এমনিতেই জ্বলছিল। এবার অঝোর ধারায় বর্ষণ শুরু হলো।
রেহানা আবার বারান্দায়। কীভাবে ৩২ নম্বর যাওয়া যায়? এই পথ ধরে এক দৌড় দিলে কত মিনিট লাগবে? বড় রাস্তাটা পার হতে পারলেই তো ভেতরের রাস্তা। সেখানেও কি মিলিটারি থাকবে?
একটা চড়ুই পাখি মাথার ওপরে চক্কর খাচ্ছে। পাখিটা একটা ভেন্টিলেটরে বসল। আরেকটা চড়ুই পাখি কোত্থেকে এসে কিচিরমিচির করে ডাকতে লাগল। নিচে খড়কুটা পড়ে আছে। বোধ হয় পাখিগুলো বাসা বানাবে।
রেহানা, এই রেহানা–কিশোরী কণ্ঠের ডাকে চমকে উঠলেন রেহানা। আরে এ যে স্বপ্ন! ওর বাসা যে পাশেরটাই, রাতের অন্ধকারে তা ঠাওর করে উঠতে পারেননি রেহানা। এখন দিনের আলোয় এই কথাটা তার মনে পড়ল! বন্ধু স্বপ্নদের বাড়িই তো ওইটা!
আয় আয়, ভেতরে আয়-রেহানা দরজা খুলে দিলেন। সালোয়ার-কামিজ পরা স্বপ্নারও চোখের নিচে কালি। গোলাগুলির শব্দে ওরও নিশ্চয়ই ঘুম হয়নি।
স্বপ্ন ভেতরে এলেন। আপা দ্যাখো। স্বপ্না এসেছে। ওর বাসা তো পাশেরটাই, রেহানা বললেন। স্বপ্ন এসেছিস, খুব ভালো হয়েছে, এই বাড়িতে একটা ছুরি বা বঁটি কিছুই নাই। তোর বাসা থেকে একটা ছুরি বা বঁটি এনে দে না।
হাসিনা বললেন, না না, স্বপ্ন। পরিস্থিতি খুব ভয়াবহ। আর্মিরা পাগলের মতো করছে।
ঠিক এই সময় আবারও গুলির গুড়ুম গুডুম শব্দ কান ফাটিয়ে ফেলতে লাগল। জানালার কাঁচ কেঁপে উঠল। একঝক কাক বাড়ির চারপাশজুড়ে কা কা করে ডাকতে লাগল ভয়ার্ত স্বরে।