চৌকিতে বসেছেন তাজউদ্দীন আর আমীর।
বাইরে প্রচণ্ড শব্দ হলো, এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ হলো, মনে হচ্ছে আকাশ ভেঙে পড়ছে মাথার ওপর। সঙ্গে সঙ্গে চৌকির চার পা আত্মসমর্পণ করল, আর চৌকিটা বিকট শব্দ করে ভেঙে পড়ল নিচে। আমীর ও তাজউদ্দীন চৌকি থেকে ছিটকে পড়লেন। চারদিক থেকে একযোগে গুলির শব্দ আসছে। গুলির শব্দ, গোলার শব্দ, ট্যাংকের চাকার ঘর্ঘর আওয়াজ আসছে পুবে ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে, দক্ষিণে পিলখানার দিক থেকে, দক্ষিণ-পশ্চিমে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিক থেকে, আরও কোন কোন দিক থেকে, কীভাবে হিসাব মেলাবেন তাজউদ্দীন! তাঁরা বাড়ির ছাদে উঠলেন। অমাবস্যার অন্ধকারকে বিদীর্ণ করে আকাশে ফাটছে ট্রেসার বুলেট, আগুনে আলোয় বিজুলিতে, শব্দে, গর্জনে, আর্তনাদে কিয়ামত নেমে এসেছে ঢাকায়। ওই ওদিকে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা বুঝি কামান-ট্যাংকের গোলায় মাটির সঙ্গে গুঁড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। পুরান ঢাকা বোধ হচ্ছে গোটাটাই পুড়ছে। আকাশ গনগনে লাল। কোথাও কোথাও থেকে জনতার স্লোগান আসছে, জয় বাংলা। মোহাম্মদপুর বিহারি ক্যাম্প এলাকা থেকে শোনা যাচ্ছে পাকিস্তান জিন্দাবাদ ধ্বনি। তারপর সব স্লোগান থেমে গেল। রইল শুধু থেমে থেমে গুলির আওয়াজ। গোলার আওয়াজ। হঠাৎ হঠাৎ গাড়ির শব্দ। ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টার এই বাড়ির অদূরে। আর্মি সেখানে ক্যাম্প করছে, অন্ধকারের মধ্যেও তা বোঝা যাচ্ছে।
২৬ মার্চ সকাল হলো। তাজউদ্দীন একটা জানালার পাল্লা একটুখানি খুলে দিলেন, অমনি ঘরপোড়া ছাইয়ের পাশুটে গন্ধ তার নাকে এসে লাগল। তিনি আবার জানালা বন্ধ করে দিলেন। আমীর-উল ইসলাম বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, একটা কাজ করি। দাড়ি কেটে আসি। তাজউদ্দীন ভালো করে শুনলেন সেই কথা। মানুষের জীবনে এমন সময় আসে, যখন একমুহূর্তে এক লক্ষ ভাবনা মস্তিষ্কের কোষে হানা দিতে পারে! মুজিব ভাই কি বেঁচে আছেন, থাকলে কোথায় আছেন? লিলি, রিমি, রিপি, মিমি কেমন আছে? ঢাকাবাসীর কতজন বেঁচে আছে? কতজন মারা গেছে? কতজন গুলিবিদ্ধ, অগ্নিদগ্ধ হয়ে এখনো কাতরাচ্ছে যন্ত্রণায়?
আমীর-উল বাথরুম থেকে বেরোলেন। তার গাল-চিবুক নিকোনো উঠোনের মতো পরিষ্কার। তাঁকে চেনাই যাচ্ছে না। তাজউদ্দীন বললেন, একেবারে নতুন একজন মানুষকে দেখছি। আপনাকে তো চেনাই যাচ্ছে না।
ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে আর্মি ক্যাম্পে ওয়াচ টাওয়ার বসানো হয়েছে। এই বাড়িটা তার দৃষ্টিসীমার মধ্যে।
গফুর সাহেব উদ্বিগ্ন চেহারা নিয়ে এই ঘরে ঢুকলেন। তার গেঞ্জির গলাটা অকারণে বড়, লুঙ্গির অনেকটাই ঝুলন্ত গেঞ্জি ঢেকে রেখেছে। তার হাতে একটা গামলা। গামলায় কিছু মুড়ি। বললেন, শুকনা মুড়ি গলা দিয়ে ঢুকবে না। মুড়ি ভিজায়ে আনি। গুড় আছে। গুড় দিয়ে মেখে খাই।
.
আমীর-উল ইসলাম বললেন, তাজউদ্দীন ভাই, আমাকে তো আর চেনা যাচ্ছে না। আমার নাম আজ থেকে রহমত আলী। আমি পাবনা থাকি। গফুর সাহেবের বাড়ি বেড়াতে এসেছি।
তাজউদ্দীন বললেন, আমার নাম মোহাম্মদ আলী। গফুর ভাই, আপনি কন্ট্রাক্টর। আমি আপনার ঠিকাদারি কাজ দেখাশোনা করি।
পানিতে ভেজানো মুড়ি এসে গেল। কিন্তু তাজউদ্দীনের গলা দিয়ে সেই মুড়িও নামতে চাইছে না।
রেডিওতে ঘোষণা শোনা গেল–কারফিউ। দিনের বেলাতেও থেমে থেমে গুলির আওয়াজ আসছে। রোদে পোড়া একটা অসহ্য অকথ্য দিন পেরিয়ে গেল। রাতের বেলা রেডিওর পাশে বসে আছেন চারজন শ্রোতা। থ্রিব্যান্ড রেডিও। রেডিও অস্ট্রেলিয়া, বিবিসি, আকাশবাণী জানাল, পাকিস্তানি মিলিটারি ট্যাংক কামান স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র নিয়ে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপরে হিংস্র শ্বাপদের মতো আক্রমণ করেছে, বাড়িঘর পুড়িয়ে দিয়েছে, নির্বিচার গণহত্যা চালাচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদের চোয়াল শক্ত হয়ে আসছে। কী করা উচিত, কী করা কর্তব্য–তিনি ভাবছেন। তার মনে পড়ছে, মুজিব ভাই তাকে এবং কজন ছাত্রনেতাকে ডেকে ১৮ জানুয়ারি কলকাতার একটা ঠিকানা মুখস্থ করিয়েছিলেন। ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খান, মণি, রাজ্জাক, তোফায়েল ছিলেন। ছাত্রনেতাদের বলেছিলেন, আমার অবর্তমানে তাজউদ্দীনের সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করবা। কলকাতার ঠিকানাটা মুখস্থ আছে তো! ২৬ রাজেন্দ্র প্রসাদ রোড, ভবানীপুর, কলকাতা। চিত্তরঞ্জন সুতার হলো কন্ট্যাক্ট পারসন। তাঁর কাছে যাবা।
.
এই বাড়ি থেকে লালমাটিয়ার পানির ট্যাংক দেখা যাচ্ছে। মিলিটারির লোকজন এগিয়ে গেল পানির ট্যাংকের কাছে। তারা দারোয়ানকে বেদম প্রহার করছে। দারোয়ান চাবি নিয়ে পানি ছাড়তে গেল। সব দেখা যাচ্ছে। স্পষ্ট। সব বোঝা যাচ্ছে। এই বাড়িতে থাকা আর নিরাপদ মনে হচ্ছে না। তারা পর্দা টেনে দরজা-জানালা বন্ধ করে রইলেন।
রেডিওতে ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনতে হলো। রেডিওর ঘর্ঘর শব্দের সঙ্গে ইয়াহিয়া মদ-ভারী কণ্ঠে বলছেন :
মাই ডিয়ার কান্ট্রিমেন,
আসোলামু আলাইকুম…
শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের অসহযোগ আন্দোলন মুসলিম দেশ পাকিস্তানকে ভেঙে ফেলার উদ্দেশ্যে হিংসাত্মক কার্যকলাপ ছাড়া আর কিছু নয়। আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করা হলো। আসলে আরও কয়েক সপ্তাহ আগেই শেখ মুজিব ও তাঁর অনুসারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল। শেখ মুজিব এবং তার দল পাকিস্তানের শত্রু, তারা পূর্ব পাকিস্তানকে দেশ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করতে চায়। তিনি দেশের ঐক্য ও সংহতিকে আক্রমণ করেছেন। এ অপরাধের শাস্তি তাঁকে পেতেই হবে। হিজ ক্রাইম উইল নট গো আনপানিশড।