একটা ঘর থেকে এই নারীকন্ঠের চিৎকার আসছে। ঘরের জানালা দিয়ে ভেতরে তাকিয়ে শেখ মুজিব দেখতে পেলেন, আম্বিয়ার মা ও মামা গো বলে গলার রগ ফুলিয়ে চিৎকার করছে। ভেতরে আরও আছে রমা, ফরিদ, নিয়াজ, আজিজ মিয়া–তাঁর বাড়ির কাজের লোকেরা। মুজিব রেগে গেলেন। সেন্ট্রিদের বললেন, এই, তোমাদের অফিসার কে আছে, ডাকো তো এক্ষুনি।
অফিসার এলেন। মুজিব রাগতস্বরে ইংরেজিতে বললেন, আমাকে এনেছ এনেছ। তোমরা আমার বাড়ির কাজের লোকদের কেন এনেছ? এই বুড়িকে আনার মানে কী? এক্ষুনি এদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।
২৮ মার্চ একটা ট্রাকে করে বাড়ির গৃহকর্মীদের তুলে নিয়ে রাস্তায় ছেড়ে দেওয়া হয়। মিরপুর রোডে, আইয়ুব গেটের কাছে।
৩
ব্যাঙ্গমা বলে, বিবিসি লন্ডন ২৬ মার্চ রাত দশটায় এই খবর প্রচার করে।
ব্যাঙ্গমি বলে, খবরটা ইংরেজি। তুমি বাংলা কইরা শোনাও। ব্যাঙ্গমা বাংলায় বিবিসির ২৬ মার্চের খবর শোনায় :
বিবিসি লন্ডন। ২৬ মার্চ ১৯৭১। এ.৪৩। ২২.০০ পাকিস্তান-ওয়ান।
ইয়াহিয়া খান তাঁর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পদক্ষেপ নেওয়ার পর এবং ভারত থেকে পাওয়া খবর অনুসারে শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশকে স্বাধীন বলে ঘোষণা দেওয়ায় পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক যুদ্ধের খবর পাওয়া যাচ্ছে। ঢাকায় আমেরিকান কনসাল জেনারেল বলেন, বিদ্রোহ দমনের জন্য ট্যাংক ব্যবহার করা হয়েছে। ভারত থেকে পাওয়া আগের খবর হলো, একটা গুপ্ত বেতার থেকে বলা হয়েছে, বিভিন্ন জায়গায় ভয়াবহ যুদ্ধ চলছে।
৪
আমি ভেতরে, তাজউদ্দীন বাইরে-মুজিব ভাইয়ের বহু বছর আগে বলা। কথাটা হঠাৎই তার কানে আসে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবিতে ১৯৪৮ সালে শেখ মুজিব বড় আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন, ১১ মার্চ হরতালে পিকেটিং করছিলেন, জিপ নিয়ে পুলিশ তাকে ধাওয়া করছিল, আর তিনিও সাইকেলে চড়ে রাস্তার এক মোড়ের সমাবেশ থেকে আরেক সমাবেশে যাচ্ছিলেন, জিপিওর সামনে থেকে গেলেন ইডেন বিল্ডিংয়ে, তোপখানা রোডের সচিবালয়ের সামনে, মুজিব ভাইকে পুলিশ এখনই গ্রেপ্তার করবে, মুজিব ভাই ইঙ্গিত করলেন, তাজউদ্দীন, তুমি গ্রেপ্তার এড়াও। আমি ভেতরে, তুমি বাইরে। তাজউদ্দীন খবরের কাগজের রিপোর্টার সেজে পকেট থেকে নোটবই বের করে নোট করতে লাগলেন। পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার না করে মুজিব ভাই এবং অন্যদের গ্রেপ্তার করে নিয়ে চলে গেল।
কাঠের চৌকিতে একটা চাদর পেতে শুয়ে আছেন তাজউদ্দীন। পাশে আমীর-উল ইসলাম। আমীর ডান কাত হয়ে শুয়ে ছিলেন। চিত হওয়ার চেষ্টা করছেন শব্দ না করে। কিন্তু দুর্বল চৌকি কাঁচ কাঁচ করে আর্তনাদ করল।
ঘুম তো কিছুতেই আসে না। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় কে ঘুমাতে পেরেছে?
রাতে বাড়ি থেকে লুঙ্গির ওপরে পাঞ্জাবি পরে নিয়ে একটা রাইফেল, একটা রিভলবার, একটা কাঁধে ঝোলানো থলে নিয়ে বেরিয়েছেন তাজউদ্দীন। আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে কামাল হোসেনও ছিলেন। কামাল হোসেন ধানমন্ডির ১৩ নম্বর সড়কে তার এক আত্মীয়ের বাড়ির গেটে নেমে গেছেন। তাজউদ্দীন আর আমীর-উল এগিয়ে যাচ্ছেন, উত্তরের দিকে, ইচ্ছা আছে, কোনোরকমে পশ্চিমের নদীর ধারে চলে যাওয়া। আলপথ ধরে জলাজঙ্গল পেরিয়ে একটা নৌকা যদি রাতের অন্ধকারে জোগাড় করে ফেলা যায়, তাহলে হয়তো আপাতত গ্রেপ্তার এড়ানো সম্ভব হবে। কিন্তু উত্তর দিক থেকে গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে আসছে মিলিটারি কনভয়। গাড়ি ডানে ঘুরিয়ে ফেলে তারা ঢুকে পড়লেন লালমাটিয়ার মধ্যে।
আমীর-উল চালককে বললেন, গফুর সাহেবের বাড়ির সামনে আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি নিয়ে ভেগে যাও।
রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়ির পাশের বাড়িটাই লালমাটিয়ার সংগ্রাম পরিষদের বাড়ি। ছেলেরা তখনো ওই বাড়িতে ভিড় করে আছে। তাজউদ্দীন ছেলেদের ডাকলেন। বললেন, এই বাড়ির বাতি নিভিয়ে দাও। পতাকা নামিয়ে ফেলো। তোমরা এখনই নিরাপদ জায়গায় চলে যাও। সরে থাকো। গ্রেপ্তার এড়াও। যাও।
ছেলেরা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদকের কথা শুনল। তারা পতাকা নামাল। বাতি নিভিয়ে দ্রুত এলাকা ত্যাগ করল। ততক্ষণে গুলির শব্দ, বোমার শব্দ কানে আসতে শুরু করেছে।
.
ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে তাজউদ্দীন বেল টিপলেন। মনে মনে তারা আল্লাহকে ডাকছেন যেন গফুর সাহেব বাড়ি থাকেন। দরজা খুলে গেল। তাজউদ্দীন বললেন, গফুর সাহেব, আপনার বাড়িতে মেহমান এসে গেছে। তাড়াতাড়ি দরজাটা খুলুন।
আসেন আসেন। বাড়িতে কোনো মহিলা নাই। আমরা দুই চাচা ভাতিজা। আরও দুইজন পুরুষ মানুষ আরামে থাকতে পারবেন। তবে অসুবিধা হলো কোনোরকমে একটা চৌকি আছে। আপনাদের ওই চৌকিতেই থাকতে হবে। ফার্নিচার কেনার সময়-সুযোগ-মন কোনোটাই অসহযোগের মধ্যে ছিল না।
তাজউদ্দীন বললেন, এর মধ্যে আর খাট আর চৌকি। একটা আশ্রয় পেলেই হলো।
আবদুল গফুর সাহেব দরজা বন্ধ করে জানালার পর্দা টেনে দিয়ে বললেন, এত গোলাগুলি। কী পরিস্থিতি, তাজউদ্দীন সাহেব?
তাজউদ্দীন বললেন, পাকিস্তানি মিলিটারি অ্যাটাক করেছে। মুজিব ভাই চট্টগ্রামে মেসেজ পাঠিয়েছেন রেজিস্ট্যান্স গড়ে তোলার জন্য। দেশের অন্য। জায়গাগুলোতে ওয়্যারলেসে স্বাধীনতার ঘোষণা মেসেজ করেছেন। ইনডিপেনডেনস হ্যাঁজ বিন ডিক্লেয়ারড। তবে আমি তার হাঁটু ধরে বলেছি, সরে যান। বাড়ি ছাড়েন। তিনি আমাদের চলে যাবার নির্দেশ দিয়েছেন। কিন্তু নিজে কোথাও যাবেন না। নিজের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন। আল্লাহ জানে তার কী অবস্থা হবে!