ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ত্রিকালদর্শী। কিন্তু জাহান্নামের আগুনকে হার মানানো এই পরিস্থিতিতে তারাও স্তম্ভিত। খানিকক্ষণ চুপ করে থাকে তারা। আশ্রয় নেয় রামপুরা বিল পেরিয়ে এক হিজলগাছের ডালে। বিলের একধারে বস্তির আগুনে আকাশ লাল হয়ে আছে। আর তারই আভায় নিচে পানিতে দেখা যাচ্ছে লাশ আর রক্তের স্রোত। সেখানেই-বা ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমি থাকে কী করে? তারা বলে, চলো আবার যাই বটগাছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছে। বটগাছটার মায়া তারা ছাড়তে পারে না।
ব্যাঙ্গমা বলে, বঙ্গবন্ধুরে গাড়িতে তুইলা মেজর জেড এ খানের মনে। পইড়া যায়, তারে হুকুম দেওয়া হইছে শেখ মুজিবরে অ্যারেস্ট করার। কিন্তু ধরার পর কই লইয়া যাইতে হইব, এইটা তো কওয়া হয় নাই।
ব্যাঙ্গমি বলে, ৩২ নম্বরে গোলাগুলি, বোমাবাজি কইরা শেখ মুজিবরে পাইয়াই তারা ওয়্যারলেসে জানায় দিছিল, বড় পাখিটারে পাওয়া গেছে।
ব্যাঙ্গমা বলে, লে. কর্নেল জেড এ খান শেখ সাহেবরে অ্যাসেম্বলি ভবনের সিঁড়িতে বসায়া রাইখা গেলেন ক্যান্টনমেন্টে। লে. জেনারেল টিক্কা খানের লগে দেখা করলেন। টিক্কা খান বহুত খুশদিল। শেখ মুজিবরে ধরা হইছে, সারা ঢাকা জ্বালায়া দেওয়া হইতেছে। বহুত খুব। শেখ মুজিবের ওয়্যারলেস বার্তা রেডিওতে ধরা পড়ছে, টিক্কা খানের সহকারী একটা রেডিও নিয়া ছুঁইটা আইছিল, স্যার স্যার শোনেন, শেখ মুজিব ওয়্যারলেসে মেসেজ দিতাছে। রেডিওতে ধরা পড়ছে। এইবার ব্যাটা নিজেই ধরা পড়ছে। মুজিবরে ধইরাই মেজর ওয়্যারলেসে জানান দিছে, বিগ বার্ড ইজ ইন দ্য কেজ।
জেড এ খান বুট টুইকা স্যালুট মারলেন। মনে মনে কইলেন, আমি হালায় গোলাগুলির মধ্যে অ্যাকশন কইরা আইলাম, আর আপনে আরাম কইরা চেয়ারে বইসা গুনগুন কইরা গান গাইতাছেন। দেই আপনের শান্তি নষ্ট কইরা।
টিক্কা খান জিগায়, শেখ মুজিবরে অ্যারেস্ট করছ?
আমি তো ঠিক শিওর না। একটা লোকরে আনছি। দেখতে মজিবরের মতন। কিন্তু মজিবরই কি না কেমনে কই? বাঙালিরা বিচ্ছু জাত, মজিবরের মতো দেখতে বসায়া রাইখা মজিবররে সরায়া রাখতে পারে।
টিক্কা খান সিট থাইকা ছিটকায়া পড়ল।
.
টিক্কা খান পাঠালেন কর্নেল এস ডি আহমদকে। যাও, দেখে এসো, ঠিকঠাক লোককে ধরা হয়েছে কি না।
এস ডি আহমেদ গেলেন অ্যাসেম্বলি ভবনের সিঁড়িতে। চারদিকে সশস্ত্র পাহারা। তার মধ্যে জিপের সবুজ সিটে বসা দীর্ঘাঙ্গী একজন মানুষ। তার গায়ে সাদা পাঞ্জাবি, পরনে সাদা পায়জামা। মুখে জ্বলন্ত পাইপ।
দেখামাত্রই এস ডি আহমেদ চিনে ফেললেন শেখ মুজিবকে।
তাঁকে সালাম জানিয়ে বললেন, স্যার। আপনার এখানে তো আসার কথা প্রধানমন্ত্রী হয়ে। অথচ আপনাকে আনা হলো কয়েদি হিসেবে।
মুজিব বললেন, আমার জীবনে এটা তো নতুন কোনো ঘটনা নয়। তবে জিপের গদিতে বসা একটা নতুন ঘটনা!
কর্নেল বললেন, আপনি কি চা খেতে চান? আমি ব্যবস্থা করতে পারি।
মুজিব হাসলেন। বললেন, চমৎকার হবে। চা দেন। আমার জীবনে চা খাবার জন্য এর চেয়ে ভালো সময় আর আসেনি। ওয়ান্ডারফুল। ওয়ান্ডারফুল। দিস ইজ দ্য বেস্ট টাইম অব মাই লাইফ টু হ্যাভ টি।
কর্নেল এস ডি আহমেদ ফিরে গেলেন জেনারেল টিক্কা খানের কাছে। ঠিক লোককেই ধরা হয়েছে।
মেজর জেড এ খান বললেন, স্যার, তাহলে শেখ সাহেবকে আমরা কোথায় রাখব?
টিক্কা খান পিঠ চুলকানোর জন্য তাঁর বেতের লাঠিটা হাতে ধরলেন। বেকায়দা জায়গায় চুলকাচ্ছে। তাই তো। সব ঠিক করা হয়েছে। কিন্তু শেখ মুজিবকে কোথায় রাখা হবে, সেটা তো ঠিক করা হয়নি।
কর্নেল এস ডি খান বললেন, স্যার। অফিসার্স মেসে রাখলে কী হয়? আগরতলা মামলায় তো সেখানেই রাখা হয়েছিল।
বহুত খুব।
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে আসা হলো সেই মেসে। একটা রাত রাখা হলো তাঁকে সেখানে।
ভোররাতে টিক্কা খান হাঁক পাড়লেন, এই কে আছিস? কর্নেল এস ডি খানকে বোলাও। আমাদের কি মাথা খারাপ হয়ে গেছে যে সেই পুরোনো মেসে মুজিবকে রাখা হয়েছে। জনতা যদি টের পায় মুজিব এখানে, হাজারে হাজারে আসবে, লাখে লাখে আসবে। ছিনিয়ে নিয়ে যাবে তাদের নেতাকে। সরাও তাঁকে।
সকাল সকাল শেখ মুজিবকে তারা সরিয়ে নিল ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আদমজী স্কুলে।
হেডমাস্টারের রুমে আনা হলো তাকে। রুমে একটা ইজিচেয়ার আছে। বড় টেবিল আছে। সামনে বসার জন্য অনেকগুলো হাতলওয়ালা চেয়ার আছে। কিন্তু কোনো বিছানা-বালিশ নেই। বাথরুম নেই।
অফিসার বললেন, স্যার, আপনি এই ইজিচেয়ারে আরাম করুন। আমরা বিছানা-বালিশের ব্যবস্থা করছি।
মুজিব বললেন, আরাম করব?
ইয়েস স্যার।
মুজিব বললেন, শোনেন অফিসার। আপনি হুকুমের চাকর। আপনাকে আমি কিছু বলব না। শুধু একটা কথা আমি বলি। এই জীবনে অত্যাচার আমি। অনেক সহ্য করেছি। সেই ১৯৪৮ সাল থেকে জুলুম করছেন। কিন্তু আমি অপমান সইতে পারি না। আপনারা বাঙালিদের শুধু জুলুম করেন নাই, অপমানও করেছেন। এর শাস্তি আপনারা পাবেন। সমস্ত বাংলাদেশ কামান, ট্যাংক, বন্দুকের বোমা, গোলা, আগুনে ধ্বংস করে দিয়ে আপনি বলছেন আমাকে ইজিচেয়ারে আরাম করতে। আপনি যদি আমার সামনে থেকে সরে যান, কেবল তাহলেই আমি আরাম পেতে পারি। বুঝেছেন?
ইয়েস স্যার। স্যালুট দিয়ে অফিসার রুম থেকে বিদায় নিলেন। বাথরুম এই রুমের বাইরে, টানা বারান্দার মাথায়। শেখ মুজিব রুম থেকে বের হয়ে বাথরুমে যাচ্ছেন। হঠাই চিৎকার, মামা গো!