আপাতত নিজের জীবন নিয়ে তিনি ভাবিত নন। নিজের জীবন, নিজের নিরাপত্তা নিয়ে তিনি কমই ভেবেছেন জীবনে। এত গোলাগুলির আওয়াজ আসছে! কত মানুষই না মারা পড়ছে! বহু মানুষ রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছিল। তাদের কি নির্বিচার গুলি করা হচ্ছে?
এত শব্দ কেন? এত গর্জন কেন? এত আগুন কেন? এত বোমা-বারুদ ট্যাংক। বাংলাদেশের মানুষ তো অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি। এবার নেবে। বাঙালি পুলিশ, বাঙালি আনসারের হাতে অস্ত্র ও গোলা বিকেলের মধ্যেই তুলে দেওয়ার নির্দেশ তিনি দিয়ে রেখেছেন। বাঙালি ইপিআরও প্রস্তুত। বাঙালি সৈন্যরা বিদ্রোহ করতে চায়, এই খবর তাঁর কাছে অনেকবার এসেছে। আর যদি একটা গুলি চলে…যদি বাংলার মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেসুঝে কাজ করবেন। নির্দেশ পরিষ্কার। ১৪ মার্চ ৩৫টি নির্দেশনা লিখিতভাবে জারি করা হয়েছিল, তাতে তো লিখিতভাবেই বলা হয়েছিল, বাংলাদেশের শাসনভার হাতে তুলে নেওয়া হলো। বলা হয়েছিল, আই অ্যাপিল টু দ্য পিপল টু রিমেইন রেডি ফর অ্যানি স্যাক্রিফাইস অ্যান্ড শুড ফোর্স বি আনলিশড অ্যাগেইনস্ট দেম, টু রেজিস্ট ইট বাই অলমিনস। যদি হামলা হয়, সর্বশক্তি দিয়ে তা প্রতিরোধ করতে হবে।
রেনু এখন কী করছে? রাসেল কি ফিডারের দুধ শেষ করতে পেরেছিল? হাসিনা, রেহানা, ওয়াজেদ মিয়া অন্য বাড়িতে। ওরা কি নিরাপদে আছে? কামাল কি এখনো রাস্তায় ব্যারিকেড দিচ্ছে? যে হারে গুলি হচ্ছে, কামাল বেঁচে থাকবে কি না সন্দেহ!
এরা কি ভেবেছে? গুলি করে আমার মানুষদের স্তব্ধ করে দেবে? এটা হয়? আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবায়া রাখতে পারবে না।
গাড়ি নির্মীয়মাণ পার্লামেন্ট হাউসের সামনে এসেছে সম্ভবত। ক্যানভাসের ছাউনির নিচে দুই সৈনিকের মধ্যখানের ফোকর দিয়ে বাইরের গাছপালা ঘরবাড়ি দেখে তিনি তাদের অবস্থান বোঝার চেষ্টা করলেন। ট্রাকের সামনে পেছনে তাকিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, লুই কানের নকশা করা পার্লামেন্ট ভবনের সামনেই তারা এখন অবস্থান করছেন।
ফার্মগেটের দিক থেকে স্লোগান শোনা যেতে লাগল উচ্চ স্বরে। আর মানুষের দৌড়ের আওয়াজ। শেখ মুজিবকে গ্রেপ্তারের নেতৃত্ব দেওয়া লে. কর্নেল জেড এ খান প্রমাদ গুনলেন। জনতা নিশ্চয়ই শেখ মুজিবকে উদ্ধার করতে আসছে। তিনি সৈন্যদের নির্দেশ দিলেন, হাতিয়ার তোলো। ফায়ার করার জন্য প্রস্তুত হও।
দূর থেকেই ভেসে এল গুলির শব্দ। পায়ের আওয়াজ। জনতা পালাচ্ছে। একটু পরে জেড এ খান জানতে পারলেন, জনতা ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করতে এগিয়ে আসছিল। কামান, এলএমজি, রকেট লঞ্চারের তোপের মুখে পড়িমরি পালিয়েছে। পালানোর আগে মরেছে, দৌড়ে পালাতে পালাতে পড়ে গেছে।
গাড়িবহর ক্যান্টনমেন্টের দিকে গেল না। নির্মাণাধীন অ্যাসেম্বলি ভবনের সামনে দাঁড়াল। সৈন্যরা এক সারি আগে নামল। তারপর শেখ মুজিবকে। বলল, আপনাকেও নামতে হবে। মুজিব ট্রাক থেকে নামলেন। সিঁড়ির ওপরে পা রাখলেন।
সিঁড়ি বেয়ে উঠছেন তাঁরা। অনেকগুলো সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। বাইরে থেকে দেখলে বোঝা যায় না এই সিঁড়িগুলো এতটা ওপরে উঠে গেছে। একের পর এক সিঁড়ি বেয়ে ভবনের বাইরে জনচক্ষুর আড়ালে একটা জায়গা বাছাই করে থামলেন তাঁরা।
জিপ থেকে খুলে নিয়ে আসা একটা গদি পেতে সিঁড়িতেই তাকে বসতে দেওয়া হলো। খোলা আকাশের নিচে তারা। তিনি আকাশের দিকে তাকালেন। চৈত্রের আকাশে অনেক তারা। এক কোণে মেঘ। আকাশে কোনো চাঁদ নেই। বসন্তের বাতাস বইছে। বাতাসে ফুলের গন্ধ নয়, বারুদ, আগুন, ছাই, রক্তের গন্ধ। তা সত্ত্বেও ঘর্মাক্ত শরীরে এই দখিনা বাতাস যেন মমতার স্পর্শ বুলিয়ে দিতে চাইছে।
আকাশে ট্রেসার বুলেট জ্বলছে। কালো আকাশ বিদ্যুৎ-চমকিত হয়ে পুড়ে যাচ্ছে। বোমা বিস্ফোরণের শব্দে রাতের ঘুম ভেঙে কাক উড়তে শুরু করেছে আকাশে। হঠাৎ সেই আকাশে তিনি দেখতে পেলেন যেন আব্বার জ্যোতির্ময় মুখ। শেখ লুত্যর রহমান যেন তাকে বললেন, অনেস্টি অব দ্য পারপাজ আর সিনসিয়ারিটি অব দ্য পারপাজ তোমার আছে। তুমি বিজয়ী হবে। বাংলার মানুষ বিজয়ী হবে।
২
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটগাছের ডালে বসে থাকতে পারে না। চারদিকে আগুন, চারদিকে গুলির শব্দ, চারদিকে মানুষের আর্তনাদ, মানুষের পালানোর পায়ের শব্দ। ট্যাংকের ঘর্ঘর আওয়াজ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রাবাস লক্ষ করে কামান দাগা হচ্ছে। শিক্ষকদের কোয়ার্টারে গিয়ে নাম ধরে ধরে শিক্ষকদের ডেকে নিয়ে ব্রাশফায়ার করা হচ্ছে। জগন্নাথ হল থেকে ছাত্রদের ধরে এনে মাঠে লাইন করে দাঁড় করিয়ে চালানো হচ্ছে গুলি। জ্বলছে বস্তিগুলো। জ্বলছে ঘরবাড়ি। রাজারবাগ পুলিশ লাইনের পুলিশেরা ট্যাংক, কামান, রিকোয়েললেস রাইফেল, এলএমজির গোলাগুলির বিরুদ্ধে তাদের থ্রি নট থ্রি রাইফেল দিয়ে প্রতিরোধ গড়ার চেষ্টা করছে। আমৃত্যু মরিয়া প্রতিবাদ। জ্বলছে পিলখানা। লাশ আর লাশ। আগুন আর আগুন। গোলা আর বারুদ। নরকের দরজা খুলে দেওয়া হয়েছে বাংলায়। আক্রমণ চলছে বাঙালি পুলিশদের ওপর। থানায় টেবিলের ওপারে ডিউটিতে বসে থাকা পুলিশ আকস্মিক আক্রমণে গুলিবিদ্ধ হয়ে পড়ে থাকছে টেবিলের ওপরেই, বহু জায়গায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ঘুমন্ত সৈনিক এবং তাদের পরিবার-পরিজন নারী-শিশুদের ওপরে চালানো হচ্ছে গুলি, বিছানা বালিশের ওপরে পড়ে থাকছে রক্তাক্ত নারী, শিশু, বৃদ্ধের লাশ।