রেনু বললেন, হ্যাঁ। আমিও কত কথা শুনি। তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে স্লোগান উঠছে। মিছিল হইছে। মুক্তিযোদ্ধারা কেউ তাজউদ্দীনের কথায় অস্ত্র জমা দিবে না। আবার মোশতাক ভাই এসে কত কথা বলে গেল। মণিরা আরেক দিকে নানান কথা কয়। তুমি ছাড়া এই পরিস্থিতি কেউ সামলাতে পারবে না।
আমি যেদিন বলব, সেদিনই আমার ছেলেরা অস্ত্র জমা দিবে। কিন্তু দ্যাখো কত কাজ। রাস্তাঘাট ভাঙা। ব্রিজ-কালভার্ট নাই। বাড়িঘর বিধ্বস্ত। একটাই জিনিস আছে। আমার দেশের মানুষ। আর আমার দেশের মাটি। আমি এই দেশটাকে গড়ে তোলার জন্য আবার যদি একটু বাইরে যাই, তুমি মাইন্ড কোরো না। কয়েকটা দিন।
আব্বা, শুধু কয়েকটা দিন? আচ্ছা। রাসেল মাথা তুলে বলল।
রেনু বললেন, আমি কি কোনো দিনও তোমাকে দেশের কাজ করতে বাধা দিছি? তুমি তোমার জীবন উৎসর্গ করে রাখছ দেশের জন্য। দেশের জন্যই তো তুমি কাজ করবা। আমার কোনো আপত্তি নাই। এখন স্বাধীন দেশ। এখন তো সংসারটা সামলাতে আগের মতো কষ্ট পেতে হবে না। নয়টা মাস আমরা কী কষ্ট করছি। তবে দেশের মানুষের কষ্টের তুলনায় সেটা কিছু না। আমার ৩২ নম্বরের বাড়ি ছারখার করছে, টুঙ্গিপাড়ার বাড়ি পোড়ায়া দিছে।
মুজিব বললেন, আবার সব হবে। এই দেশের মাটি সোনার। আমরা সোনার বাংলাই গড়ব, রেনু। তুমি কেঁদো না…
.
ভোর হচ্ছে। পাখিরা ডাকছে ধানমন্ডির গাছে গাছে। কুয়াশা ভেদ করে আলো আসছে পুবের জানালা দিয়ে। জয় ঘুম থেকে উঠেছে, হাসিনা তাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটছেন। ওয়াজেদ মিয়া মর্নিংওয়াক করতে বাইরে বেরোলেন। রেনু নামাজ শেষে জায়নামাজ গুটিয়ে উঠলেন।
শেখ মুজিবের ঘুম ভেঙে গেলে তিনি দেখতে পেলেন, রাসেল তাঁকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাচ্ছে। তার গা থেকে লেপ সরে গেছে। তিনি ছেলের গায়ে লেপ তুলে দিলেন। রাসেল হাত সরাচ্ছে না। শেখ মুজিব বিছানা ছাড়তে পারছেন না। তিনি ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। ঘুমজড়ানো চোখে দুপায়ে শব্দ তুলে এই ঘরে এলেন রেহানা। তার আব্বার আরেক পাশে শুয়ে তিনি তাকে জড়িয়ে ধরে বললেন, আব্বা, আমি ছোটবেলায় ভাত না খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আপনি রাতের বেলা বাড়ি ফিরে আমাকে ভাত তুলে খাওয়াতেন। আজকে আমি আপনাকে ভাত তুলে খাওয়াব!
রেনু জানালার পর্দা সরিয়ে দিলেন। দেখা গেল, কতগুলো পায়রা বাইরে ওড়াউড়ি করছে। ৩২ নম্বরের পায়রাগুলো কি বেঁচে আছে? থাকলে কোথায় থাকে তারা? কী খায়? কে তাদের খাবার দেয়!
হাসিনা এলেন জয়কে কোলে নিয়ে। জয়কে তার নানা আর খালার মাঝখানে শুইয়ে দিলেন তিনি।
আলো এসে পড়েছে হাসুর আব্বার মুখে। আব্বার মুখটা বেশ রোগা দেখা যাচ্ছে। জয় খিলখিল করে হেসে উঠলে শেখ মুজিব বললেন, ফেরেশতারা জয়কে হাসাচ্ছে। এত ছোট বাচ্চারা তখনই হাসে, যখন ফেরেশতারা তাদের হাসায়।
[যারা ভোর এনেছিল উপন্যাসধারা সমাপ্ত]