আপনারা আমার সাথে সকলে একটা মোনাজাত করেন। বঙ্গবন্ধু হাত তুলে মোনাজাত ধরেন। সেটা শেষ করে তিনি নিজেই স্লোগানের নেতৃত্ব দিতে লাগলেন–
বললেন, স্লোগান ধরুন : জয় বাংলা।
জয় বাংলা স্লোগানে পৃথিবী কেঁপে উঠল।
শহীদস্মৃতি
অমর হোক।
এবার বঙ্গবন্ধু একটা নতুন স্লোগান ধরবেন। তিনি প্রথমে নিজেই প্রস্তাব এবং জবাব, দুটো অংশই বললেন–বাংলাদেশ-ভারত ভাই ভাই।
তিনি হাবিব ও কলরেডি মাইকের মাউথপিসে বললেন, বাংলাদেশ ভারত।
দশ লাখ কণ্ঠ জবাব দিল, ভাই ভাই।
বঙ্গবন্ধু এরপর শহীদ মিনারে যান। তিন নেতার মাজারে যান। তারপর ধানমন্ডি ১৮ নম্বর সড়কের বাড়িটিতে আসে তাঁর গাড়ি। সেখানেও মানুষ আর মানুষ। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের ক্যামেরা। টেলিভিশন ক্যামেরা। চলচ্চিত্রের ক্যামেরা। বাড়ির ভেতরেই গাড়ি ঢোকে। মানুষের ভিড়ে বঙ্গবন্ধু বেরোতে পারছিলেন না। ভিড় ঠেলে তিনি নামলে তাঁর বড় মেয়ে হাসিনা তাঁকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়েন। জামালের কোলে ছিল রাসেল। বাবা-মেয়ের মোলাকাত শেষ হলে রাসেল আব্বার কোলে ওঠে। তারপর কামালের কোলে তার স্থান হলে মুজিব বাড়ির ভেতরে ঢোকেন। হলরুমে রেহানা তাঁকে ফুল দেন। বাড়ির ছোটরা ফুল ছিটাতে থাকে। ভিড় ঠেলে মুজিব গেলেন তার আব্বার কাছে। তার পায়ের কাছে নত হলেন। শেখ লুত্যর রহমান তাঁর মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। চোখের পানি সামলালেন অতিকষ্টে। মুজিব গেলেন মায়ের কাছে। মা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লেন। পুরো বাড়ির সবাই তখন চোখ মুছছে।
মানুষের ভিড়ের চাপে তিনি এক ঘর থেকে আরেক ঘরে যেতে পারছিলেন না। অনেক কষ্টে রেনুর ঘরে গেলে রেনু তাকে বললেন, সব ঘরেই মানুষ, বাইরে মানুষ, তুমি বাইরের ঘরেই বসো। আমি দেখি, চায়ের ব্যবস্থা কী করা যায়। তুমি জয়কে দেখো। ওকে কোলে নাও।
হাসিনা আনলেন তার ৫ মাস ১৩ দিন বয়সী সন্তান জয়কে।
রেনু বললেন, আমার ভাই তো দেখতে তার নানার মতো হয়েছে।
রেহানা আর রাসেল আব্বার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে।
মুজিব বললেন, রাসেল আসো। ভাগনেকে তুমি আদর করো?
রাসেল বলল, হ্যাঁ। অনেক আদর করি।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন। ঢোকার পথ করে উঠতে পারছেন না। সবখানে মানুষ আর মানুষ।
পেছনের দরজা দিয়ে বাড়িতে ঢুকলেন। বসলেন বাইরের ঘরে। বঙ্গবন্ধু এলেন সেই ঘরে। তাজউদ্দীনের পাশে বসে উপস্থিত সাংবাদিকদের সঙ্গে শেখ মুজিব কথা বলতে লাগলেন। তিনি বললেন, আজ আমি বড় ক্লান্ত। আজকে আর নয়। আরেক দিন সংবাদ সম্মেলন করে কথা বলব।
ভিড়ের চোটে এই বাড়িতে টেকা দায়। তাজউদ্দীন বিদায় নিলেন। শেখ মুজিবকে গরম পানি করে দিয়েছেন রেনু। বললেন, তুমি গোসল সেরে নাও। একটুখানি ভাত খাবে। রেনুর ঘরেই ভাতের ব্যবস্থা হলো।
রাতে এলেন চার ছাত্রনেতা। রাজ্জাক, তোফায়েল, মণি, সিরাজ। ওয়াজেদ মিয়া তাদের বসালেন তাঁর ঘর আর বেগম মুজিবের ঘরের মধ্যখানে ড্রেসিংরুমে। শেখ মুজিব ছাত্রনেতাদের কাছ থেকে শুনলেন মুক্তিযুদ্ধের সময়ের কাহিনি। ওয়াজেদ মিয়া পাশে বসে সব শুনলেন।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, ওয়াজেদ মিয়া তার বইয়ে লেখছেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে, কলকাতায় প্রবাসী সরকার, তাগো মন্ত্রী, সেক্টর, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি প্রসঙ্গে চার ছাত্রনেতা বঙ্গবন্ধুরে ব্রিফ করলেন। এখন সংকট কোথায়, কী করণীয়, তা-ও তাঁরা কইলেন। বঙ্গবন্ধু সব শুনলেন। রাত নয়টায় তিনি ছাত্রনেতাগো বিদায় দিলেন।
এই বাড়ি ছোট। উল্টা দিকের একটা দোতলা বাড়ি বেগম মুজিব ভাড়া নিয়া রাখছিলেন। সেই বাড়িতে জিনিসপাতি লওয়া হইতেছিল। ভারতীয় সৈন্যরা এত দিন এই বাড়ি পাহারা দিতেছিল। এবার ১৫-২০ জন বাঙালি পুলিশ চইলা আসল। মুজিব ভারতীয় মেজররে কইলেন, তোমরা আমার জন্য অনেক কষ্ট করছ। আমি আইসা গেছি। আমার নিজের দেশে আমার কোনো ভয় নাই। বাঙালি পুলিশ আছে। তারাই যথেষ্ট। তোমরা আর কষ্ট কইরা বাড়ির সামনে খাড়ায়া থাইকো না। ক্যান্টনমেন্টে গিয়া আরাম কইরা ঘুমাও।
.
ভারতীয় সৈন্যরা রেনুকে সালাম জানিয়ে বিদায় নিল।
বহু রাতে বাড়িটা একটু হালকা হলো। ঘনিষ্ঠ আত্মীয়স্বজন বাদে নেতা কর্মীরা বিদায় নিলেন।
মুজিব এলেন রেনুর ঘরে। রাসেল তখনো জেগে।
রাসেল বলল, আব্বা, তুমি এসেছ। আর তোমাকে আমরা ছাড়ব না।
রেনু বললেন, আমারও একই কথা হাসুর আব্বা। তুমি এই দেশকে স্বাধীন করতে চাইছিলা। স্বাধীন করছ। আর তোমাকে আমরা ছাড়ব না। আর শোনো, আমি কিন্তু বঙ্গভবন বা হেয়ার রোডে কোথাও যাব না। সামনের দোতলাটা ভাড়া নিছি। সেখানে থাকব। ৩২ নম্বরের বাড়ি মেরামতের কাজ শেষ হলে সেখানে উঠব। তাজউদ্দীনের ওয়াইফ লিলি আসছিল। তাজউদ্দীনরা হেয়ার রোডের বাড়িতে উঠছে। ওদের ধানমন্ডির বাড়িতেও তো কিছু নাই। ঝাঁঝরা কইরে দিয়েছে। যাক, ওরা উঠছে উঠছে। আমি ধানমন্ডি ছাড়তাছি না।
মুজিব বললেন, তুমি যা বলবা, তা-ই হবে। আমি কি আর বঙ্গভবনের মতো প্রাচীরঘেরা বাড়িতে উঠতে পারি! আমি জনগণের নেতা। আমাকে জনগণের মধ্যেই থাকতে হবে। দেশটা একটু ঠিক হোক, পরিস্থিতি ভালো হোক, দেখো আমি টুঙ্গিপাড়ায় চলে যাব। সেখানে বাইগার নদীতে মাছ ধরে সময় কাটাব। কিন্তু তার আগে যে অনেক কাজ!