আমি আজ বাংলার মানুষকে দেখলাম, বাংলার মাটিকে দেখলাম, বাংলার আকাশকে দেখলাম, বাংলার আবহাওয়াকে অনুভব করলাম। বাংলাকে আমি সালাম জানাই। আমার সোনার বাংলা, তোমায় আমি বড় ভালোবাসি। বোধ হয় তার জন্যই আমায় ডেকে নিয়ে এসেছে।
দুনিয়ার সব রাষ্ট্রের কাছে আমার আবেদন–আমার রাস্তা নাই, আমার ঘাট নাই, আমার খাবার নাই। আমার জনগণ গৃহহারা, সর্বহারা, আমার মানুষ পথের ভিখারি। তোমরা আমার মানুষকে সাহায্য করো, মানবতার খাতিরে তোমাদের কাছে আমি সাহায্য চাই। দুনিয়ার সকল রাষ্ট্রের কাছে আমি সাহায্য চাই। আমার বাংলাদেশকে তোমরা রিকোগনাইজ করো। জাতিসংঘের ত্রাণ দাও, দিতে হবে, উপায় নাই, দিতে হবে। আমি আমরা হার মানব না। আমরা হার মানতে জানি না। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী/ রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ করোনি। কবিগুরুর আজ মিথ্যা কথা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে। আমার বাঙালি আজ মানুষ। আমার বাঙালি আজ দেখিয়ে দিয়েছে। দুনিয়ার ইতিহাসে এত লোক আত্মাহুতি, এত লোক জান দেয় নাই। তাই আমি বলি, আমাদের দাবায়া রাখতে পারবা না।
আজ থেকে আমার অনুরোধ, আজ থেকে আমার আদেশ, আজ থেকে আমার হুকুম, ভাই হিসেবে, নেতা হিসেবে নয়, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নয়, প্রেসিডেন্ট হিসেবে নয়, আমি তোমাদের ভাই, তোমরা আমার ভাই। এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মানুষ পেট ভরে ভাত না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি বাংলার মা-বোনেরা কাপড় না পায়, এ স্বাধীনতা আমার পূর্ণ হবে না, যদি এ দেশের যুবক যারা আছে, তারা চাকরি না পায়। মুক্তিবাহিনী, ছাত্রসমাজ, তোমাদের মোবারকবাদ জানাই। তোমরা গেরিলা হয়েছ, তোমরা রক্ত দিয়েছ, রক্ত বৃথা যাবে না, রক্ত বৃথা যায় নাই।
একটা কথা, আজ থেকে বাংলায় যেন আর চুরি-ডাকাতি না হয়। বাংলায় যেন আর লুটতরাজ না হয়। বাংলায় যারা অন্য লোক আছে–অন্য দেশের লোক, পশ্চিম পাকিস্তানের লোক, বাংলায় কথা বলে না, তাদের বলছি, তোমরা বাঙালি হয়ে যাও। আর আমি আমার ভাইদের বলছি, তাদের উপর হাত তুলো না। আমরা মানুষ, মানুষ। ভালোবাসি।
তবে যারা দালালি করেছে, যারা আমার লোকদের ঘরে ঢুকে হত্যা করেছে, তাদের বিচার হবে এবং শাস্তি হবে। তাদের বাংলার স্বাধীন সরকারের হাতে ছেড়ে দেন, একজনকেও ক্ষমা করা হবে না। তবে আমি চাই, স্বাধীন দেশে স্বাধীন আদালতে বিচার হয়ে এদের শাস্তি হবে। আমি দেখিয়ে দিতে চাই দুনিয়ার কাছে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি রক্ত দিতে জানে, শান্তিপূর্ণ বাঙালি শান্তি বজায় রাখতেও জানে।
আমায় আপনারা পেয়েছেন, আমি আসছি। জানতাম না, আমার ফাঁসির হুকুম হয়ে গেছে। আমার সেলের পাশে আমার জন্য কবর খোঁড়া হয়েছিল। আমি প্রস্তুত হয়ে ছিলাম। বলেছিলাম, আমি বাঙালি, আমি মানুষ, আমি মুসলমান–একবার মরে দুইবার মরে না। আমি বলেছিলাম, আমার মৃত্যু আসে যদি, আমি হাসতে হাসতে যাব, আমার বাঙালি জাতিকে অপমান করে যাব না, তোমাদের কাছে ক্ষমা চাইব না। এবং যাবার সময় বলে যাব, জয় বাংলা, স্বাধীন বাংলা, বাঙালি আমার জাতি, বাংলা আমার ভাষা, বাংলার মাটি আমার স্থান।
ভাইয়েরা আমার, যথেষ্ট কাজ পড়ে রয়েছে, আমার সকল জনগণকে দরকার। যেখানে রাস্তা ভেঙে গিয়েছে, নিজেরা রাস্তা করতে শুরু করে দাও। আমি চাই জমিতে যাও, ধান বুনো, কর্মচারীদের বলি, একজনও ঘুষ খাবেন না। মনে রাখবেন, তখন সুযোগ ছিল না, আমি অপরাধ ক্ষমা করব না।
ভাইয়েরা আমার, যাওয়ার সময় আমাকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। তাজউদ্দীন, নজরুলরা আমাকে ছেড়ে যায়। আমি বলেছিলাম, সাত কোটি বাঙালির সাথে মরব, আমাকে ডেকো না, আমি আশীর্বাদ করছি। ওরা কাঁদছিল। আমি বলি, তোরা চলে যা, আমার আস্থা রইল। আমি এই বাড়িতে মরতে চাই। এটাই হবে বাংলায় জায়গা। এখানেই আমি মরতে চাই। ওদের কাছে মাথা নত করতে আমি পারব না।
ডা. কামালকে নিয়ে তিন মাস জেরা করছে, আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দাও, কয়েকজন বাঙালি আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দিয়েছে। তাদের আমরা জানি চিনি এবং তাদের বিচারও হবে। আপনারা বুঝতে পারেন…
নমো নমো নমো বাংলাদেশ মম চির মনোরম চির মধুর, বুকে নিরবধি বহে শত নদী চরণে জলধির বাজে নূপুর। আজ আমি যখন এখানে নামছি, আমি আমার চোখের পানি ধরে রাখতে পারি নাই। যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কি না। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি। বাংলার ভাইয়েদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।
পশ্চিম পাকিস্তানের ভাইদের বলি, তোমরা সুখে থাকো। তোমার সামরিক বাহিনীর লোকেরা যা করেছে, আমার মা-বোনদের রেপ করেছে, আমার ৩০ লক্ষ লোককে মেরে ফেলে দিয়েছে, যাও সুখে থাকো। তোমাদের সাথে আর না, শেষ হয়ে গেছে। তোমরা স্বাধীন থাকো, আমিও স্বাধীন থাকি।
তোমাদের সাথে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বন্ধু হতে পারে, তা ছাড়া বন্ধু হতে পারে না। তবে যারা অন্যায়ভাবে অন্যায় করেছে, তাদের বিরুদ্ধে যথেষ্ট ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আপনাদের কাছে আমি ক্ষমা চাই। আমি আরেক দিন বক্তৃতা করব, একটু সুস্থ হয়ে লই। আপনারা চেয়ে দেখেন, আমি সেই মুজিবুর রহমান আর নাই। আমার বাংলার দিকে চেয়ে দেখেন, সমান হয়ে গেছে জায়গা, গ্রামের পর গ্রাম পুড়ে গেছে। এমন কোনো পরিবার নাই, যার মধ্যে আমার লোককে হত্যা করা হয় নাই।