আচ্ছা, সরকার কোন ধরনের হওয়া উচিত?
সংসদীয় পদ্ধতির। সবারই তা-ই মত।
ব্রিটিশ স্টুয়ার্ড এসে জানালেন, বিমান বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ঢুকে গেছে।
মুজিব জানালায় গিয়ে বসলেন। তিনি বাংলাদেশের রূপ দেখবেন। বললেন, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে একটা চক্কর দিতে বলো। আমি দেশটাকে একবার ভালো করে দেখে নিই।
তা-ই হলো। ৪৫ মিনিট ধরে চক্কর দিল বিমান। মুজিব আবৃত্তি করতে লাগলেন, নমো নমো নমো বাংলাদেশ মম চির মনোরম চির মধুর…
১০ জানুয়ারি ১৯৭১। দুপুরবেলা। সূর্য পশ্চিমে হেলে পড়ার অভিসন্ধি করছে। ডানায় রোদের গন্ধ মুছে নিয়ে রুপালি ব্রিটিশ বিমান তেজগাঁও বিমানবন্দরের মাটি ছুঁল। তেজগাঁও থেকে রেসকোর্স ময়দান পর্যন্ত লক্ষ লক্ষ নারী-পুরুষ আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারা পাগলের মতো হয়ে গেল।
সব প্রটোকল, সব শৃঙ্খলা ভেঙে গেল, যখন বিমানের দরজায় শেখ মুজিব এসে দাঁড়ালেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন ফুলের মালা হাতে সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ে। নজরুল মালা দিলেন। মুজিবকে আলিঙ্গন করলেন। তাজউদ্দীন মালা দিলেন। মুজিবকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর দুজনে প্রাণভরে কাঁদতে লাগলেন। এত কান্নাও বুঝি এই দুজনের বুকে জমাট বেঁধে ছিল! কাঁদতে কাঁদতে তাজউদ্দীন বললেন, মুজিব ভাই, আপনি আসছেন, আমার কাঁধের বোঝা নেমে গেল। বঙ্গবন্ধু বললেন, তাজউদ্দীন, তোমার ওপরে আমার বিশ্বাস ছিল, আমি জানতাম, পারলে তুমিই পারবে। এর মধ্যে ছাত্রনেতারা উঠে গেছেন সিঁড়িতে। তোফায়েল, রাজ্জাক, নূরে আলম সিদ্দিকী, মাখন, রব, শাজাহান সিরাজ…
শেখ কামাল প্যারেডের পাশে। শেখ লুৎফর রহমান নিচে একটা জায়গায় দাঁড়িয়ে আছেন…মানুষের ঢেউ সামলাতে পারছে না বাংলাদেশের পুলিশ, ভারতীয় সৈন্যরা…
রেনু, হাসিনা, রেহানা, রাসেল, সায়েরা খাতুন সবাই ধানমন্ডি ১৮ নম্বরের বাড়িতে রেডিওর পাশে বসে আছেন। তাঁরা ধারাবিবরণী শুনছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একটা খোলা ট্রাকে উঠেছেন। তাঁর পাশে সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীন, মোশতাকসহ মন্ত্রীরা। তাঁর পাশে ছাত্রনেতারা। জনতার ভিড় ঠেলে গাড়িবহর এগোতে চেষ্টা করছে। দুই পাশে মানুষ আর মানুষ। শেখ মুজিব জিন্দাবাদ ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস কাঁপছে। রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছাতেও তাঁদের দুই ঘণ্টা লেগে গেল। অনেক উঁচু করে বানানো মঞ্চে উঠতে মুজিবের জন্যও যেন সুই পরিমাণ জায়গা নেই। মানুষ পাগলের মতো ছুটে আসছে মুজিবকে একটু ছোঁয়ার জন্য। অতি কোশেশ করে বঙ্গবন্ধু মঞ্চে উঠতে পারলেন। রেসকোর্স ময়দান উপচে পড়ছে মানুষে।
শেখ মুজিব চোখ মুছতে মুছতে মাইকের সামনে দাঁড়ালেন। তাঁকে কাঁদতে দেখে বিশ লাখ চোখ সিক্ত হয়ে উঠল। কালো প্রিন্স কোট পরা মুজিবকে অনেক শুকনো দেখাচ্ছে। তিনি বললেন :
আমি প্রথমে স্মরণ করি আমার বাংলাদেশের ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী, জনগণকে, হিন্দু-মুসলমানকে, যাদের হত্যা করা হয়েছে, আমি তাদের আত্মার মঙ্গল কামনা করি।
আমি আপনাদের কাছে দু-এক কথা বলতে চাই। আমার বাংলাদেশ আজ স্বাধীন হয়েছে, আমার জীবনের সাধ আজ পূর্ণ হয়েছে, আমার বাংলার মানুষ আজ মুক্ত হয়েছে। আমি আজ বক্তৃতা করতে পারব না। বাংলার ছেলেরা, বাংলার মায়েরা, বাংলার কৃষক, বাংলার শ্রমিক, বাংলার বুদ্ধিজীবী যেভাবে সংগ্রাম করেছে–আমি কারাগারে বন্দী ছিলাম, ফাঁসিকাষ্ঠে যাবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম, কিন্তু আমি জানতাম আমার বাঙালিকে দাবায়া রাখতে পারবে না। আমার যেই ভাইয়েরা জীবন দিয়েছে, তাদের আমি শ্রদ্ধা নিবেদন করি, তাদের আত্মার মাগফেরাত কামনা করি।
আজ প্রায় ৩০ লক্ষ মানুষকে মেরে ফেলা হয়ে হয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে, প্রথম বিশ্বযুদ্ধেও এত মানুষ এত সাধারণ জনগণ মৃত্যুবরণ করে নাই, শহীদ হয় নাই, যা আমার সাত কোটির বাংলায় করা হয়েছে। আমি জানতাম না আমি আপনাদের কাছে ফিরে আসব। আমি খালি একটা কথা বলেছিলাম, তোমরা যদি আমাকে মেরে ফেলে দাও কোনো আপত্তি নাই, মৃত্যুর পরে তোমরা আমার লাশটা আমার বাঙালির কাছে দিয়ে দিয়ো–এই একটা অনুরোধ তোমাদের কাছে।
আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই ভারতবর্ষের সামরিক বাহিনীকে, আমি মোবারকবাদ জানাই রাশিয়ার জনগণকে, আমি মোবারকবাদ জানাই জার্মানি, ব্রিটিশ, ফ্রান্স সব জায়গার জনগণকে, তাদের আমি মোবারকবাদ জানাই, যারা আমাকে সমর্থন করেছে।
আমি মোবারকবাদ জানাই আমেরিকার জনসাধারণকে, মোবারকবাদ জানাই সারা বিশ্বের মজলুম জনগণকে, যারা আমার এই মুক্তিসংগ্রামকে সাহায্য করেছে। আমার বলতে হয় এক কোটি লোক এই বাংলাদেশ থেকে ঘরবাড়ি ছেড়ে ভারতবর্ষে আশ্রয় নিয়েছিল, ভারতের জনসাধারণ, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী তাদের আশ্রয় দিয়েছেন, তাঁদের আমি মোবারকবাদ না দিয়ে পারি না। অন্য যারা সাহায্য করেছেন, তাঁদের আমার মোবারকবাদ দিতে হয়।
তবে মনে রাখা উচিত, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র। বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে। বাংলাদেশকে কেউ দমাতে পারবে না। বাংলাদেশকে নিয়ে ষড়যন্ত্র করে লাভ নাই। আমি যাবার আগে বলেছিলাম, ও বাঙালি, এবার তোমাদের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমি বলেছিলাম ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমরা ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে সংগ্রাম করেছ, আমি আমার সহকর্মীদের মোবারকবাদ জানাই। আমার বহু ভাই বহু। কর্মী আমার বহু মা-বোন আজ দুনিয়ায় নাই, তাদের আমি দেখব না।