ব্যাঙ্গমা বলবে, দিল্লি এয়ারপোর্টে শেখ মুজিব বিমানের দরজায় দাঁড়াইলেন।
ব্যাঙ্গমি বলবে, য্যান স্বর্গ থাইকা দেবদূত বাইর হইলেন।
তিনি কইলেন, জয় বাংলা।
সমবেত বিশিষ্টজনেরাও বইলা উঠলেন, জয় বাংলা।
পুরো ভারতের শীর্ষ পর্যায়ের সব গুরুত্বপূর্ণ মানুষ সেইখানে হাজির। আছেন রাষ্ট্রপতি ভি ভি গিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, ভারতের মন্ত্রীরা, কূটনীতিকেরা, সাংবাদিকেরা। মুজিব নামতাছেন। স্লোগান উঠল, শেখ মুজিব জিন্দাবাদ, লং লিভ শেখ মুজিব। সবুজে কালো প্রিন্স কোট পরা শেখ মুজিব হাত নাড়লেন। দীর্ঘ উড়ালের ক্লান্তিও য্যান তারে কাবু করতে পারতেছে না।
ভি ভি গিরি তারে জড়ায়া ধরলেন। ইন্দিরা গান্ধী মিষ্টি হাসি দিয়া হাত বাড়ায়া তারে উষ্ণ করমর্দনের মাধ্যমে অভ্যর্থনা জানাইলেন। ক্যামেরার ক্লিক। ক্লিক। মুভি ক্যামেরার ফিতার ঘূর্ণন। তিন বাহিনীর সদস্যরা তারে গার্ড অব অনার দিলেন। তারপর তারে নিয়া যাওয়া হইল ভিআইপি প্যান্ডেলে। ফুলের বৃষ্টি আইসা পড়তেছে তার উপরে। মঞ্চে উঠলেন তিনি। ভারতের জাতীয় সংগীত বাজল। তাঁর গুর্খা বাদকদল বাজাইল : আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…
শেখ মুজিবরে মালাম এয়ারপোর্টে যখন নানা রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়া যাইতে হইতেছিল, তখন ভিআইপি প্যান্ডেলে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। সবাই চেয়ার ছাইড়া উইঠা শেখ মুজিবরে দেখার জন্য ছোটাছুটি শুরু কইরা দেয়।
.
শেখ মুজিবকে নিয়ে ছয় দরজার মার্সিডিজ গাড়ি যাচ্ছে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে। এরই মধ্যে শশাঙ্ক ব্যানার্জি দেখা করেছেন ডি পি ধরের সঙ্গে। জানিয়ে দিয়েছেন, মুজিব চান ভারতের সৈন্য প্রত্যাহারের সময় তিন মাস এগিয়ে আনা হোক…
নয়াদিল্লিতে একটা জনসভাতেও ভাষণ দেন মুজিব। তিনি ইংরেজিতে বক্তৃতা শুরু করেন লেডিস অ্যান্ড জেন্টলমেন বলে…জনতা চিৎকার করে ওঠে, বাংলা বাংলা।
মুজিব তাকান ইন্দিরার দিকে। ইন্দিরা বলেন, আপনি বাংলায় বলুন। তিনি শুরু করেন, ভাই ও বোনেরা আমার…জনতা হর্ষধ্বনি করে ওঠে…
এরই মধ্যে দিল্লি-ঢাকা যৌথ ঘোষণায় অবিলম্বে ভারতীয় সৈন্যদের ফিরে যাওয়ার ঘোষণা ঠাঁই করে নিয়েছে।
১২৭
পুরো বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ, প্রতিটা গাছ, প্রতিটা পাখি, প্রতিটা প্রাণী, নদীর ঢেউ, আকাশের তারা, প্রতিটা ধূলিকণা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে একটা মানুষের ভালো থাকার জন্য কায়মনোবাক্যে নিশিদিন প্রার্থনা করেছে। প্রতিমুহূর্তে তার নিরাপদ সুস্থ প্রত্যাবর্তনের জন্য দোয়া করেছে। সংগ্রাম করেছে। চেষ্টা করেছে। সেই আশা আজ পূর্ণ হতে চলেছে। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২। বাঙালির মুক্তিদাতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজ ফিরে আসছেন। রেডিওতে এই ধরনের ধারাবিবরণী হচ্ছে, যা মোটেও বাড়িয়ে বলা নয়।
ছোট্ট রাসেল একটা নতুন মুক্তিযোদ্ধার ইউনিফর্ম পরেছে। এটা তার জন্য তড়িঘড়ি করে বানিয়ে দেওয়া হয়েছে। সে অনুকরণ করেছে তার ১৭ বছর বয়সী মুক্তিযোদ্ধা ভাই জামালকে। শেখ কামাল এখন বাংলাদেশ আর্মির কমিশনপ্রাপ্ত অফিসার। তিনিও আর্মির ইউনিফর্ম পরেছেন। রেহানা ফুলের মালা গেঁথে রেখেছে নিজের হাতে। বাড়ির আরও শিশু সদস্য ফুল হাতে প্রস্তুত। নব্বই-ঊর্ধ্ব শেখ লুৎফর রহমান বিমানবন্দরে হাজির। কিন্তু হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে আছে বিমানবন্দরে। তিন বাহিনীর একটা দল গার্ড অব অনার দেওয়ার জন্য প্রস্তুত। ওসমানী সেসবের দেখভাল করছেন। সালাম গ্রহণের জন্য মঞ্চ তৈরি।
ব্রিটিশ কমেট দিল্লি থেকে ঢাকার দিকে রওনা দিয়েছে। ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় রাষ্ট্রপতির বিমান রাজহংসে করে দিল্লি থেকে ঢাকা ফ্লাইটের ব্যবস্থা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর জিনিসপত্র রাজহংসে তোলাও হয়েছিল। মুজিব বললেন, সে কী করে হয়! ব্রিটিশ বিমানে ঢাকা যাব বলেই তো ব্রিটিশদের কথা দিয়ে রওনা দিয়েছি। এখন মাঝপথে বন্ধুর বিমান পেয়েছি বলে ওদের বিদায় করে দিতে পারি না। সেটা অসৌজন্য হবে।
বিমানে আছেন ড. কামালের পরিবার, আবদুস সামাদ আজাদ, প্রটোকল অফিসার ফারুক চৌধুরী, সাংবাদিক আতাউস সামাদ, ইনস্যুরেন্স কোম্পানির মাওলা, ভেদ মারওয়া, শশাঙ্ক ব্যানার্জি। শেখ মুজিব বারবার করে গাইছেন : আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি।
আবদুস সামাদ আজাদ জানাচ্ছেন কী নৃশংস অত্যাচারই না পাকিস্তানি বাহিনী করেছে বাঙালিদের ওপরে!
আতাউস সামাদও মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে গল্প করছেন অসংকোচে। কামাল। হোসেন নানা বিষয়ে মত দিচ্ছেন।
ফারুক চৌধুরী জুনিয়র অফিসার, দিল্লি এয়ারপোর্টে দেওয়া রাষ্ট্রপতির ভাষণ তিনি লিখেছেন অশোক হোটেলের কামরায় বসে, সংকোচে দূরে বসে আছেন।
মুজিব বললেন, আমাদের পতাকায় বাংলাদেশের ম্যাপটার কি দরকার আছে?
না, পৃথিবীর কোনো দেশের পতাকায় তো ম্যাপ থাকে না।
একজন জানালেন, এরই মধ্যে তাজউদ্দীন সাহেব একই কথা বলেছেন। ম্যাপের আকার ঠিক হয় না। ম্যাপে জায়গা কমানোও ভালো নয়, বাড়ানোও ভালো নয়। ম্যাপটা না রাখাই ভালো।
জাতীয় সংগীত হিসেবে আমার সোনার বাংলা ছাড়া আর কি কিছু হতে পারে?
না না। হতে পারে না। দেশের মানুষ রক্ত দিয়ে এই গান অর্জন করে নিয়েছে।