সামনে কমলার রস, হাতে পাইপ, শেখ মুজিব বেশ খোশমেজাজেই আছেন।
শশাঙ্ককে দিল্লি থেকে একটা বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট দেওয়া হয়েছে। তাঁকে বলা হয়েছে, শেখ মুজিবকে যেন বলা হয়, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি নয়, বাংলাদেশে সংসদীয় পদ্ধতির গণতন্ত্র চালু করা ভালো হবে। ওয়েস্টমিনস্টার স্টাইলের গণতন্ত্র। দিল্লির পছন্দের একজন রাষ্ট্রপতি প্রার্থীও আছেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
শশাঙ্ক সেই কথা পাড়বার আগেই শেখ মুজিব বললেন, ম্যাডাম ইন্দিরা গান্ধীকে একটা কথা বলতে হবে। আমি দিল্লি ছাড়ার আগেই একটা কমিটমেন্ট যদি পাই, খুব ভালো হবে।
জি বলুন।
প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সাথে আমার কথা হয়েছে। ব্রিটেন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আগ্রহী। তারা বলে, মার্চের মধ্যেই ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশ ছেড়ে গেলে তারা সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে। এই কথাটা আপনি দিল্লিকে দ্রুতই জানাবেন। ম্যাডাম ইন্দিরা যেন ৩১ মার্চের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহারের কথাটা কালকে আমাদের ঢাকার ফ্লাইটের আগেই বলে ফেলেন।
শেখ মুজিব মন খুলে কথা বলছেন। শশাঙ্কও ভদ্রতা-সৌজন্য বজায় রেখে জানালেন, বাংলাদেশে কিন্তু সংসদীয় গণতন্ত্রই ভালো পদ্ধতি হবে বলে মনে হয়।
মুজিব লুফে নিলেন কথাটা। বললেন, আমি ছিলাম না, সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনরা অনেক কষ্ট করেছে। তারা একটা যুদ্ধকালীন সরকার করেছে। আমি সব সময়ই পার্লামেন্টারি ফর্ম অব গভর্নমেন্টের পক্ষে।
আপনি যদি প্রধানমন্ত্রী হন, তাহলে কে প্রেসিডেন্ট হতে পারেন? আমি লন্ডনে একজনের সঙ্গে কাজ করেছি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন, বিচারপতি…।
আবু সাঈদ চৌধুরী। গুড চয়েস। মুজিব হেসে উঠলেন। বললেন, কী ভাগ্য দেখেন, চৌধুরী সাহেব আজকে এই প্লেনে থাকতে পারতেন।
শশাঙ্ক মাথা নাড়লেন।
আমি একটু উঠি। হাঁটাচলা করি। রোজ খানিকক্ষণ না হাঁটলে আমার চলে না। এটা আমার ডেইলি রুটিনের অংশ। শেখ মুজিব হেঁটে কামাল হোসেনদের কাছে গেলেন। তার পাশে বসলেন।
বললেন, কামাল, তুমি তো আইনের লোক। সংবিধানের ব্যাপার তুমি ভালো বুঝবা। পার্লামেন্টারি ফর্ম অব গভর্নমেন্ট কি বেটার নয়?
কামাল বললেন, জি মুজিব ভাই। আমি তো তা-ই মনে করি।
.
মুজিব আবার উঠলেন। হাঁটাহাঁটি করলেন। ভেদ মারওয়ার কাছে গেলে মারওয়া তাঁকে সালাম জানালেন। মুজিব তাঁকে ইংরেজিতে বললেন, আপনি একা একা বসে আছেন কেন, আমার পাশের সিটে এসে বসুন। কথা বলি।
ভেদ মারওয়া খুবই খুশি। তিনি গিয়ে মুজিবের পাশের সিটে বসলেন।
মুজিব বললেন, তাহলে আপনি লন্ডনে ইন্ডিয়ান হাইকমিশনে ফার্স্ট সেক্রেটারি!
জি স্যার। স্যার, আমি কিন্তু বাংলা জানি। বাংলাভাষী অঞ্চলে আমার পোস্টিং হয়েছিল।
আরে আগে বলবেন তো আপনি বাংলা জানেন। বাংলায় কথা বলতে না পারলে আমার ভালো লাগে না। লন্ডনে অনেকক্ষণ ধরে ইংরেজিতে কথা বলতে বলতে চোয়ালে ব্যথা হয়ে গেল। বাংলা, আহা আমার বাংলা। ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা, তাহার মাঝে আছে দেশ এক সকল দেশের সেরা, ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
ভেদ মারওয়া শেখ মুজিবের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন অভিভূতের মতো।
শেখ মুজিব বললেন, ভারত আমাদের জন্য যা করেছে, তার জন্য আমরা চিরকৃতজ্ঞ থাকব। দুই দেশের বন্ধুত্ব চিরস্থায়ী হবে।
শেখ মুজিব জানেন, তাঁর সঙ্গে ভেদ মারওয়ার কথাবার্তা সবই ইন্দিরা গান্ধী পর্যন্ত যাবে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী উত্থান নিয়ে ভারতের ভেতরে টেনশন হওয়ার কথা। পশ্চিমবঙ্গ আবার এই স্রোতে গা ভাসাবে না তো? মুজিবের উচিত ভারতীয়দের আশ্বস্ত করা। তিনি তাই নিজে নিজেই বলতে শুরু করলেন, দেখুন, আমরা প্রথমে বাঙালি। এটা বাংলাদেশের বহু পরিচয়ের একটা। সব পরিচয়ের আগে বাঙালি পরিচয়। আমরা এ পরিচয় নিয়ে অত্যন্ত গর্বিত। এ পরিচয়কে ভিত্তি করেই স্বাধীনতার সব সংগ্রাম হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমাদের মুসলিম পরিচয়। আমি বাঙালি। আমি মুসলমান।
ভেদ মারওয়া বিস্মিত বোধ করলেন মুজিবের এই কথায়।
তিন নম্বর হলো, আমাদের আঞ্চলিক পরিচয়। আমি মুসলমান। আমাদের নৃতাত্ত্বিক মিল কিন্তু পাঠান, আফগান, ইরাকি, পারসি, তুর্কি বা মধ্যপ্রাচ্যের দেশের মানুষদের সঙ্গে নয়। আমাদের মিল দক্ষিণ এশিয়ার মানুষদের সঙ্গেই। এ অঞ্চলের সমস্যাগুলো খুব বেশি অভিন্ন। পরস্পরের ঘনিষ্ঠ সহযোগিতা ছাড়া এসব সমস্যা সমাধানের অন্য কোনো উপায় নেই।
ভেদ মারওয়া বেশ আশ্বস্ত বোধ করলেন। মুগ্ধ হলেন শেখ মুজিবের আশ্চর্য প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায়। তিনি দেখবেন, পরের দিন রেসকোর্স ময়দানে ভাষণে শেখ মুজিব এই কথাগুলোই ঠিকঠাকভাবে বলবেন।
দুবার জ্বালানি নেওয়ার জন্য থেমে ১০ জানুয়ারি সকাল ৮টা ১০ মিনিটে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে রুপালি ব্রিটিশ রয়্যাল বিমানটি অবতরণ করল।
.
ব্যাঙ্গমা বলবে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আতাউস সামাদ তখন দিল্লিতে। সরকারি সফরে। তিনি সবার আগে প্লেনে উইঠা পড়লেন। শেখ মুজিবের লগে কয়েক মিনিট গুরুত্বপূর্ণ আলাপ সাইরা নিলেন।
ব্যাঙ্গমি বলবে, তাজউদ্দীন এরই মধ্যে তাঁর মন্ত্রিসভা একটুখানি বাড়াইছেন, একটুখানি বদলাইছেন। মোশতাকরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাইকা সরায়া সেচমন্ত্রী বানায়া দিছেন। মোশতাক গোস্বা কইরা অসুখের ভান কইরা হাসপাতালে ভর্তি হইছিল। ওয়াজেদ মিয়া গিয়া তার রাগ ভাঙ্গাইছিলেন।