শেখ মুজিব হাত ছাড়ায়া লন। বলেন, ত্রিশ লক্ষ মানুষের রক্তের নিচে পাকিস্তান মারা গেছে। এই রিকোয়েস্ট আমি রাখতে পারব না। তবে দুইটা আলাদা স্বাধীন দেশ, আলাদাভাবে এই পৃথিবীর দুই প্রান্তে শান্তিপূর্ণভাবে থাকবে। এইটা তো হইতেই পারে।
ভুট্টো বলেন, তাইলে আইজকা আর প্লেন যাইতে পারবে না। ইরানের শাহ আসবে কাইলকা ভোরে। সব এয়ার রুট সিল কইরা দেওয়া হইছে।
শেখ মুজিব বলেন, প্লেন আসবে কাইলকা। আর আইজকা এয়ার রুট বন্ধ করার মানে কী? ইরানের শাহ আসার আগেই আমরা ইউরোপের আকাশে চইলা যাব। তুমি প্রেসিডেন্ট। তুমি সিএমএলএ। তোমার অর্ডারই অর্ডার। বইলা দাও, শেখ মুজিবের প্লেন চলব।
ভুট্টো তার স্টাফদের সাথে কথা কন। শেষে নির্দেশ দেন, করাচির উপর দিয়া ফ্লাই করো।
করাচির উপর দিয়া? ড. কামাল লাফায়া উঠেন। করাচিতে আমার বউ বাচ্চারা আছে। তাদেরও তাইলে তুইলা লই।
ভুট্টো হাইসা কন, আচ্ছা, কামাল সাহেবের ফ্যামিলিরে একই প্লেনে লন্ডন পাঠায়া দেও।
.
গভীর রাতে রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরে শেখ মুজিব ওঠেন প্লেনে। তাঁকে এগিয়ে দিতে প্লেন পর্যন্ত ওঠেন ভুট্টো। কামাল হোসেন যখন বিমানের ভেতরে। পা রাখলেন, দেখতে পেলেন, তাঁর স্ত্রী হামিদা এবং তার দুই ছোট্ট মেয়ে ডানা আর সারা প্লেনে বসা। চোখের পানিতে নয় মাস পর একটা পরিবারের পুনর্মিলন সম্পন্ন হলো। চার বছরের সারা তার ডাগর চোখ মেলে তার আব্বাকে জিজ্ঞেস করল, তোমাদের জেলে নিয়েছিল কেন? কারণ কি এই যে তোমরা ইলেকশনে অংশ নিয়েছিলে?
বঙ্গবন্ধু এগিয়ে গেলেন হামিদা হোসেনের দিকে। দুই মেয়ের মাথার চুল নেড়ে দিয়ে, গাল টিপে তাদের আদর করলেন। জিজ্ঞেস করলেন, যুদ্ধের এই দিনগুলোতে তোমরা কেমন ছিলে!
শেখ মুজিবকে তার আসনে বসানো হলো। সিটবেল্ট বাঁধলেন মুজিব। ককপিট থেকে পাইলট ঘোষণা দিচ্ছেন, আমি এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী। আপনাদের জাহাজের ক্যাপ্টেন। আমরা লন্ডনের দিকে যাত্রা আরম্ভ করতে যাচ্ছি। আমরা লন্ডন সময় ছয়টার দিকে হিথরো বিমানবন্দরে পৌঁছাব বলে আশা করছি। আপনার সিটবেল্ট বেঁধে রাখুন। আবহাওয়া ভালো। আমাদের ফ্লাইট নিরাপদ ও আরামদায়ক হবে বলে আমরা আশা। করছি।
প্লেন উড়তে আরম্ভ করল। শেখ মুজিব জানালা দিয়ে রাতের রাওয়ালপিন্ডির আলোর দ্রুত পশ্চাদপসরণ দেখতে লাগলেন।
তার মনে হতে লাগল, এবার বোধ হয় সত্যিই মুক্তি। জেলখানা থেকে যাত্রা অবারিত প্রান্তরে। পরাধীনতার নিগড় থেকে পাখা মেলা আলো বাতাসভরা অনন্ত সম্ভাবনার আকাশে।
আকাশে বিমান উঠে গেলে ক্যাপ্টেন জাফর চৌধুরী তাঁর আসন ছাড়লেন। যাত্রীদের কেবিনে এলেন। কামাল হোসেন ও শেখ মুজিব পাশাপাশি বসেছেন। তারা কথা বলছেন। জাফর বুঝছেন না শেখ সাহেবের সঙ্গে তিনি কী বলবেন। তিনি শুধু কামাল হোসেনকে সালাম দিলেন।
বিমানে খাবার পরিবেশন করা শুরু হলো। বিমানের ভেতরে পরিবেশটা বোধ হয় হালকা হয়ে গেছে। মুজিব তাঁর আসনে ফিরে এসেছেন। পাইলট এয়ার মার্শাল জাফর চৌধুরী গিয়ে মুজিবকে বললেন, স্যার, গুড মর্নিং। খাওয়ার সময় সালাম দিতে হয় না। তাই দিলাম না। আমি এই বিমানের পাইলট।
আচ্ছা। বসুন। আপনাদের কী অবস্থা!
এই তো স্যার চলছে।
যুদ্ধে পিআইএর কোনো ক্ষতি হয়নি?
না স্যার। ক্ষয়ক্ষতি যা হওয়ার বিমানবাহিনীর হয়ে থাকতে পারে। পিআইএর শুধু একটা টুইন অটার ঢাকা এয়ারপোর্টে বিধ্বস্ত হয়েছে। আমাদের কিছু স্টাফ ঢাকায় আটকা পড়েছেন। আর পিআইএর সব বিমান আমরা পশ্চিমে নিয়ে আসতে পেরেছি।
শেখ মুজিব বললেন, ইয়াহিয়া খান লোকটা সবকিছু ধ্বংস করে ফেলল।
সে আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল।
জাফর বললেন, কিন্তু তা তিনি করতে পারেননি। কারণ, আল্লাহ আপনার হায়াত রেখেছেন।
মুজিব বললেন, হ্যাঁ। আল্লাহর রহমত। আর মানুষের ভালোবাসা। আমার দেশের মানুষ আমাকে ভালোবাসে। তারা আমার জন্য লড়েছে। আমার কিছু হলে তারা ছাড়ত না।
আচ্ছা, আপনি রেস্ট নিন। বলে ক্যাপ্টেন ককপিটে ফিরে গেলেন।
শেখ মুজিব চোখ বন্ধ করলেন। ঘুম আসতে চাইছে না। বিমান যাচ্ছে। লন্ডনে। তিনি একটা স্বাধীন দেশের প্রেসিডেন্ট। তিনি সেই মর্যাদা নিয়ে ব্রিটেনে পা রাখতে চান। ব্যাপারটা নিশ্চিত করতে হবে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তিনি তার মধ্যে চলে গেলেন। স্বপ্নে দেখলেন তার বড় মেয়ে হাসিনাকে। হাসিনার কোলে একটা শিশু। তিনি বললেন, মা, তোর শরীরটা কেমন? হাসিনা বলল, আব্বা, তোমার শরীর এত খারাপ হয়ে গেছে কেন? তখন রাসেল এল দৌড়ে। বলল, আব্বা, তোমাকে ওরা ভাত খেতে দেয়নি। শুধু রুটি খেতে দিয়েছে। তখন হঠাৎই গুলি শুরু হলো। তাঁদের ৩২ নম্বরের বাড়ির দোতলার রুমের মেঝেতে বৃষ্টির মতো গুলি পড়তে লাগল।
ঘুম ভেঙে গেল। বিমানের ক্রুরা নাশতা নিয়ে এসেছে। মুজিব উঠে টয়লেটে গেলেন। চোখেমুখে পানি দিলেন। ফিরে এসে নাশতার সামনে বসলেন। ক্যাপ্টেন জাফর এসেছেন। তিনি বললেন, তেল নেওয়ার জন্য একটা জায়গায় আমরা অবতরণ করতে পারি। এরপর এক ঘণ্টার মধ্যে আমরা লন্ডন পৌঁছে যাব। লন্ডনে নামার ঠিক এক ঘণ্টা আগে আমরা তাদের জানাব যে আমরা আপনাকে নিয়ে সেখানে নামছি।
মুজিব বললেন, আপনি একটা ব্যাপার নিশ্চিত করুন। আমাকে রিসিভ করতে যেন ব্রিটিশ সরকারের ফরেন অফিসের অফিসাররা উপস্থিত থাকে।