.
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলাবলি করবে : বঙ্গবন্ধুরে শাহুল্লা ওরফে সিহালা গেস্টহাউসে রাখা হয়। একটা সময় তাঁরে রেডিও দেওয়া হয়। খবরের কাগজও দেওয়া হয়। শেখ মুজিব রেডিও পাইয়াই দেশ-বিদেশের খবর শুনতে থাকেন। দেশ-দুনিয়ার পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করেন। তাঁর কাছে আস্তে আস্তে স্পষ্ট হইতে থাকে যে ভুট্টো তারে মিথ্যা কওনের চেষ্টা করতেছে। পরে, কুলদীপ নায়াররে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মুজিব এই কথা স্পষ্ট করেন, মুজিব বলেন, আরে ভুট্টো তো একটা প্যাথলজিক্যাল লায়ার, হাড়ে হাড়ে মিথ্যাবাদী। তবে এইটা ঠিক যে ভুট্টো তাঁর প্রাণ বাঁচাইছেন–ভুট্টোর দেওয়া এই ধারণা বঙ্গবন্ধু অনেক দিন ধইরা রাখছিলেন, সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টরে দেওয়া সাক্ষাঙ্কারেও সেইটা আছে। এটুখানি শোনো :
ফ্রস্ট : আমি একটা বিবরণে দেখলাম, আপনাকে নাকি জেলার একসময় সরিয়ে রেখেছিল। ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আপনাকে স্থানান্তরে নিয়ে গিয়েছিল। এ কি সত্য?
বঙ্গবন্ধু : ওরা জেলখানায় একটা অবস্থা তৈরি করেছিল মনে হচ্ছিল, কতগুলো কয়েদিকে ওরা সংগঠিত করেছিল যেন সকালের দিকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয়, আমাকে তত্ত্বাবধানের ভার যে অফিসারের ওপর পড়েছিল, আমার প্রতি তাঁর কিছুটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়তোবা সে অফিসার এমনও বুঝতে পেরেছিল যে ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি দেখলাম, হঠাৎ রাত তিনটায় সে এসে আমাকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে তার নিজের বাংলোতে দুদিন যাবৎ রক্ষা করল। এই দুদিন আমার কোনো সামরিক পাহারা ছিল না। দুদিন পর এই অফিসার আমাকে আবার একটা আবাসিক কলোনির নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়তো চার-পাঁচ কিংবা ছদিন রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার বাদে আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।
ফ্রস্ট : এ তাদের সাহসেরই কাজ। এখন তাদের কী হয়েছে, তা-ই ভাবছি।
বঙ্গবন্ধু : আমিও জানি না। ওদের ওপর কোনো আঘাত হানতে ওরা পারবে বলে মনে হয় না। ওদের জন্য যথার্থ শুভকামনা রয়েছে।
ফ্রস্ট : এমনকি শেষ মুহূর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখনো নাকি সে ভুট্টোর কাছে আপনার ফাঁসির কথা বলেছিল? এটা কি ঠিক?
বঙ্গবন্ধু : হ্যাঁ, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনিটা বলেছিল। ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেওয়ার সময়ে ইয়াহিয়া বলেছিল, মিস্টার। ভুট্টো, আমার জীবনের সবচাইতে বড় ভুল হয়েছে শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি না দেওয়া।
ফ্রস্ট: ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল!
বঙ্গবন্ধু : হ্যাঁ, ভুট্টো এ কথা আমায় পরে বলেছিল, ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দেবে। কিন্তু ভুট্টো তার এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
ফ্রস্ট : ভুট্টো কী জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?
বঙ্গবন্ধু : ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলেছিল, না, আমি তা হতে দিতে পারি না। তাহলে তার মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। বাংলাদেশে এখন আমাদের সামরিক বাহিনীর এক লাখ তিন হাজার লোক আর বেসামরিক লোক বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দী রয়েছে। তা ছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। মিস্টার ইয়াহিয়া, এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটি লোকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। এর প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার অবস্থা হবে সংকটজনক। ভুট্টো এ কথা আমাকে বলেছিল। ভুট্টোর কাছে আমি অবশ্যই এ জন্য কৃতজ্ঞ।
.
ব্যাঙ্গমা বলে, বঙ্গবন্ধু এরপর অনুরোধ করেন কামাল হোসেনরে এই গেস্টহাউসে আইনা দেওনের লাইগা।
কামাল হোসেন যে পাকিস্তানের কারাগারে বন্দী, এইটা শেখ সাহেব উকিলদের মুখের কথায় আগেই বুইঝা ফেলছিলেন।
কামাল হোসেনরে এই গেস্টহাউসে আনা হয়।
ভুট্টো আবারও এই বাড়িতে আহেন। পাকিস্তানের সাথে কোনো একটা শিথিল সম্পর্ক রাখা যায় কি না, বিবেচনা কইরা দেখতে মুজিবরে অনুরোধ করেন।
শেখ মুজিবের এক কথা : আগে আমারে আমার মানুষের কাছে যাইতে দাও। তারপর আমি মুখ খুলব। তার আগে আমি এই ব্যাপারে একটা কথাও বলব না।
ভুট্টো বলে, তোমারে মুক্তি দিতে হইলে আমারেও আমার জনগণের কাছ থাইকা অনুমতি লইতে হইব। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে আমার একটা জনসভা আছে। করাচিতে হইব। সেইখানে আমি তোমার মুক্তির ব্যাপারটা পাস করায়া নিমু।
বঙ্গবন্ধু মুক্তি পাইতাছেন, এইটা স্পষ্ট হয়। ফরেন সেক্রেটারি আজিজ আহমেদ, অহন পাকিস্তানের উপপররাষ্ট্রমন্ত্রী, আইসা দেনদরবার করেন। কেমনে শেখ সাহেব ফ্লাই করবেন, কোন দেশে যাইবেন, এই সব।
ড. কামাল বলেন, জেনেভা বা ভিয়েনা।
আজিজ বলেন, সম্ভব না। আপনারা ইরান যান।
কামাল বলেন, প্রশ্নই আসে না।
আজিজ বলেন, লন্ডন।
শেখ মুজিব এবং ড. কামাল একযোগে বইলা উঠেন : হ। হ। লন্ডন।
৭ জানুয়ারিতে শেখ মুজিব আর ড. কামালরে হেলিকপ্টারে লইয়া যাওয়া হয় প্রেসিডেন্ট ভবনে। ভুট্টো তাগো ডিনার খাওয়ান। খাওয়াদাওয়া হইলে ভুট্টো শেখ মুজিবের হাতটা ধইরা কন : আমার শ্যাষ রিকোয়েস্ট। পাকিস্তান নামটা ছাইড়ো না। এটা লুজ কনফেডারেশন কইরা রাখো।