বাগমার তাঁকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। বেঁচে আছেন লোদী সাহেব, আপনি বেঁচে আছেন!
চোখের পানি মুছে লোদী বললেন, বেঁচে আছি। সেই যে ক্যান্টনমেন্টের বন্দিশালায় দুজনের দেখা হয়েছিল। আপনি আমাকে বলেছিলেন, আপনি বেঁচে থাকবেন। আবার ঢাকার এসপি হবেন। আমি বেঁচে আছি। আবার এসপি হিসেবে ডিউটি করছি। বাগমার সাহেব, আপনি তো জ্যোতিষী। আপনি তো ভবিষ্যৎ বলতে পারেন। চলেন। আপনাকে ছাড়ছি না। কোথায় যাবেন, বলেন? আমি পৌঁছে দিচ্ছি…।
সৈয়দ নজরুল, তাজউদ্দীনসহ মন্ত্রীরা বিমানবন্দর থেকে সোজা গেলেন ধানমন্ডিতে, ১৮ নম্বর রোডে বেগম মুজিবের ভাড়া করা বাড়িতে। তাঁদের সবার চোখে পানি। আমরা তো এসেছি, স্বাধীনতা এসেছে, বঙ্গবন্ধুকেও আনব–এই তাঁদের প্রতিজ্ঞা।
১২৪
একজন কর্নেল এল। জুতা ঠুকে স্যালুট করল মুজিবকে। বলল, স্যার, প্রেসিডেন্ট আসছেন।
মুজিব এখন একটা প্রাসাদোপম বাংলোয়। মেঝেতে দামি গালিচা, অনেক উঁচুতে ছাদ, সেখান থেকে নেমে এসেছে ঝাড়বাতি, মেহগনি কাঠের ভিক্টোরিয়ান স্টাইলের আসবাব–চেয়ার-টেবিল, খাট-পালঙ্ক। হাবিবের বাড়ি থেকে বিদায় করিয়ে মুজিবকে আনা হয়েছে এই প্রাসাদে।
প্রেসিডেন্ট আসছেন! ইয়াহিয়া খান! শেখ মুজিব দরজার দিকে তাকালেন। পর্দার ফাঁক দিয়ে বাইরে কতগুলো মিলিটারি গাড়ি দেখা যাচ্ছে বটে।
মুজিবের ঘরে একটা লং প্লে রেকর্ড প্লেয়ার আছে। মুজিব ছোটবেলা থেকেই গ্রামোফোনে গান শুনতে অভ্যস্ত। মুজিব একটা গান ছেড়ে দিলেন।
ইয়াহিয়া খান নয়, নীল স্যুট, লাল টাই পরা ভুট্টো জুতা মচমচ করতে করতে ঢুকলেন ঘরে।
শেখ মুজিব বললেন, ভুট্টো, তুমি? আমি তো প্রেসিডেন্টকে আশা করছিলাম!
ভুট্টো হাসলেন। হাত বাড়িয়ে করমর্দন করতে করতে বললেন, আমিই এখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট!
কী বলো? তা কী করে হয়! যত দূর মনে পড়ে, ইলেকশনে তুমি আমার চেয়ে অর্ধেক আসন কম পেয়েছিলে!
শুধু প্রেসিডেন্ট নয়, আমি প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক!
শেখ মুজিব বিস্মিত। একজন সামরিক লোক প্রেসিডেন্ট হয়, এটা আমি শুনেছি, কিন্তু একজন বেসামরিক লোক সামরিক আইন প্রশাসক হয়, এটা এই প্রথম শুনলাম! মুজিব বললেন, তা ইয়াহিয়া এখন কোথায়?
ও। তার নাম মুখে আনবে না। তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। তার বিচার হবে।
মুজিব ভুট্টোর মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন।
ভুট্টো বললেন, বসো। বসে কথা বলি। ২০ ডিসেম্বর আমি ইয়াহিয়া খানের কাছ থেকে ক্ষমতা নিয়েছি। পাওয়ার ট্রান্সফারের আগে ইয়াহিয়া খান আমাকে একটা এনভেলাপ দিয়েছে। একটা মৃত্যুদণ্ডাদেশ। শেখ মুজিব, তোমার বিচার হয়েছে সামরিক আদালতে। আদালতের রায়ে তোমার ফাঁসির আদেশ হয়েছে। প্রেসিডেন্ট হিসেবে ইয়াহিয়া তোমার মৃত্যুপরোয়ানায় সই করে রেখেছে। শুধু ডেটটা দেয়নি। আমাকে বলেছে, আমি যেন ব্যাকডেট দিয়ে নিই। যেকোনো একটা তারিখ বসিয়ে দিয়ে সুবিধামতো সময়ে তোমাকে ফাঁসিতে ঝোলাই।
মুজিব ভুট্টোর মুখ নিরীক্ষণ করে তাঁর মন পড়ার চেষ্টা করছেন। লোকটা বলতে চায় কী!
ভুট্টো বলে চলেন, আমাকে ইয়াহিয়া বলেছেন, আমার উচিত ছিল আরও অনেক আগে মুজিবকে ফাঁসিতে ঝোলানো। মুজিব একটা বিশ্বাসঘাতক। পাকিস্তানের এক নম্বর শত্রু।
তুমি কী বললে?
আমি বললাম, মুজিবকে হত্যা করা হলে বাঙালিরা বসে থাকবে না। তারা উন্মাদ হয়ে যাবে আর যেখানে যত পাকিস্তানি পাবে, তাদের সবাইকে ছিঁড়ে ফেলবে। এই পাগলামোর কোনো মানে হয় না। আপনি মুজিবের ভার আমার ওপরে ছেড়ে দিয়ে নিশ্চিন্ত থাকুন। এটা আমি ভালোভাবে সামলাতে পারব।
মুজিব বললেন, তোমাকে ধন্যবাদ। তুমি আমার প্রাণ বাঁচিয়েছ।
.
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলবে, ভুট্টো এই দাবি মুজিবের কাছে বারবার কইরা করব যে ইয়াহিয়া মুজিবরে ফাঁসি দিতে চাইছিল, আর ভুট্টো তারে বাঁচাইছে।
কিন্তু ইতিহাসে উল্টা কথাও আছে। ইয়াহিয়া খান তার জবানবন্দিতে কইছিলেন, ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে ভুট্টো আইসা ইয়াহিয়া খানের উপরে চাপ দিছিল য্যান শেখ মুজিবরে তখুনি ফাঁসিতে ঝুলায়া দেওয়া হয়!
.
ভুট্টো বললেন, আমি তোমার কাছে সাহায্য চাই। ইন্ডিয়ানরা তো ঢাকা দখল করে নিয়েছে। তোমার দেশ এখন ভারতীয় সৈন্যদের বুটের নিচে।
শেখ মুজিব মনে মনে হাসেন। জেলার হাবিব তাকে গোপন কথা বলে রেখেছেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। পাকিস্তানি সৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেছে।
কিন্তু মুজিব এই কথা ভুট্টোকে ঘুণাক্ষরেও বুঝতে দিতে চান না।
তিনি বললেন, তাই নাকি? এ তো সর্বনাশের কথা! তাহলে আমাকে এখনই ঢাকা যেতে হবে। ভারতীয় সৈন্যদের বিরুদ্ধে লড়তে হবে। আওয়ামী লীগ আমাকে ছাড়া এটা পারবে না। তুমি এখনই আমাকে ঢাকা পাঠানোর ব্যবস্থা করো।
ভুট্টো বলেন, হ্যাঁ। আমাদের দুজনার দুজনকে সহযোগিতা করতে হবে। এক দিনে সব কথা শেষ হবে না। আমি তোমার সঙ্গে আবারও দেখা করব। কথা বলব।
ভুট্টো চলে গেলেন।
মুজিব আবারও গেলেন গ্রামোফোনটার কাছে। গানটা সম্ভবত তাঁকে বাঁচিয়ে দিয়েছে। এই বাড়িতে ভুট্টো নিশ্চয়ই গোপন রেকর্ডার নিয়ে এসেছিল বা পেতে রেখেছে। শেখ মুজিব ও ভুট্টোর কথোপকথন ভুট্টো বাংলার মানুষের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে চাইবে। তিনি সেই ফাঁদে পা দিচ্ছেন না।