মুজিবনগরের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অনেকেই এসেছেন বিমানবন্দরে। এসেছেন মন্ত্রীদের পরিবারের অনেক নারী-পুরুষ-শিশু সদস্য। সবার মুখে একই সঙ্গে আনন্দ আর বিষাদ। চোখের কোণে যে অশ্রুবিন্দু চিকচিক করছে, তা কেবল দুঃখের নয়–প্রাপ্তির, অর্জনের এবং আশারও। এ এমন এক অনুভূতি, যা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না।
বিমানবন্দরে উপস্থিত আছেন রুস্তমজি, বিএসএফের ডিজি, উপস্থিত আছেন গোলক মজুমদার। বিদায়ী করমর্দন হচ্ছে। তাজউদ্দীন আহমদের মনে পড়ছে যে আমীর-উল ইসলাম আর তিনি এই দমদম বিমানবন্দরে এসেছিলেন মলিন ধূলিধূসরিত পোশাকে, এপ্রিলের এক রাতে। গোলক মজুমদার সীমান্ত থেকে গাড়ি করে তুলে এনেছিলেন তাঁদের, ভিআইপি লাউঞ্জের বাথরুমে বিএসএফের দেওয়া নতুন পোশাক পরে নিয়ে তারা উঠে পড়েছিলেন ভারতীয় বিমানবাহিনীর কার্গো বিমানে, দিল্লির উদ্দেশে। সেদিন তাঁদের ছিল মলিন বেশ, কিন্তু আত্মমর্যাদাবোধের তন্ত্রীটা বাজছিল চড়া সুরে, আমরা একটা স্বাধীন দেশের নেতা হিসেবেই আরেকটা স্বাধীন দেশে এসেছি, নিপীড়িত জনগণের মুক্তির জন্য সাহায্য চাইতে।
রুস্তমজির হাতের মধ্যে তাজউদ্দীনের হাত।
রুস্তমজি বললেন, আসুন। অল দ্য বেস্ট। আমি আশা করব, ভারত ও বাংলাদেশের মৈত্রী চিরদিন অটুট থাকবে।
তাজউদ্দীনের চোখ ছলছল করছে। তিনি কণ্ঠস্বরে দৃঢ়তা আনলেন, বললেন, হ্যাঁ, দুটো স্বাধীন দেশ সমমর্যাদার ভিত্তিতে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে যে মৈত্রীর সম্পর্ক বজায় রাখে, সেই মৈত্রীর সম্পর্ক ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে চির-অটুট থাকবে। দুটো স্বাধীন দেশ, কেউ কারও ওপরে চাপ সৃষ্টি করবে না, অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কোনো প্রভাব সৃষ্টি করবে না–এই হলো মৈত্রীর প্রথম কথা।
গোলক মজুমদার বিস্মিত বোধ করলেন। তাজউদ্দীন এমন আত্মবিশ্বাস ও মর্যাদাবোধ ধারণ করেন!
রুস্তমজিও সম্মতিসূচকভাবে মাথা নাড়লেন!
হেলিকপ্টারের দরজা বন্ধ হলো। পাখা ঘুরছে।
সৈয়দ নজরুল প্রসন্ন মুখে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে কলকাতাকে বিদায় জানাচ্ছেন। কামারুজ্জামান মনে মনে একটা কবিতার পঙক্তি ভাবছেন, কবিতাটা আসি আসি করেও কেন যেন আসছে না। ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ভাবছেন, হেলিকপ্টার কি সরাসরি ঢাকায় নামবে, নাকি যশোরে জ্বালানি নিতে থামতে হবে।
খন্দকার মোশতাকের মনটা বিষিয়ে আছে। মুখে তেতো স্বাদ। আমেরিকাকে দিয়ে চাপ সৃষ্টি করে শেখ মুজিবকে বের করে আনার তার উদ্যোগটা ভেস্তে গেল। আর ভারত ও তাজউদ্দীন তাকে ষড়যন্ত্রকারী হিসেবে চিহ্নিত করে রাখল। এখন তাজউদ্দীন প্রধানমন্ত্রী, তাঁর নেতৃত্বে মুজিবনগর সরকার দেশ স্বাধীন করে ফেলল, সেখানে মোশতাকের জায়গা কই? মুজিব এসে কী বলবেন? ঢাকায় নেমেই প্রথমে মোশতাককে যেতে হবে বেগম মুজিবের কাছে। ভাবি বলে কেঁদেকেটে বুক ভাসিয়ে দেবেন তিনি। বলবেন, আমি মুজিব ভাইকে ছাড়ানোর কত চেষ্টা করলাম, তাজউদ্দীনের ষড়যন্ত্রের কারণে পারলাম না। তা না হলে আজকে মুজিব ভাই পাকিস্তানি সৈন্যদের কান ধরে বের করে দিতেন। ভারতীয় সৈন্যও এই দেশে থাকত না। মুজিব ভাইয়ের জীবন নিয়ে আমাদের এত দুশ্চিন্তা করতে হতো না। আল্লাহ, তুমি মুজিব ভাইরে ভালো রাখো। আমি এসে গেছি ভাবি, আর আপনাদের কোনো চিন্তা নাই। তাজউদ্দীন তো চায় না শেখ মুজিব ফিরুক দেশে। তাহলে তো তার আর প্রধানমন্ত্রী থাকা হয় না। আমি এসে গেছি, বাংলার মাটিতে শেখ মুজিবকে আনবই আনব।
.
হেলিকপ্টার এসে তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ করে। বাইরে হাজার হাজার মানুষ। তারা সব নিরাপত্তাবলয় ভেঙে ছুটে এল নেতাদের ফুলের মালা পরিয়ে দেবে বলে।
গার্ড অব অনার দেওয়া হলো ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতিকে।
এই ভিড়ের মধ্যে সামনে ১৪ জনের ভিআইপি লাইন। তাতে আছেন একজন। আবদুল আজিজ বাগমার।
তাজউদ্দীন বাগমারকে দেখে জড়িয়ে ধরলেন। বাগমার, আপনি বেঁচে আছেন। আমরা তো ধরেই নিয়েছিলাম আপনি মারা গেছেন। আতিয়া কেমন আছে?
মন্ত্রীরা গাড়িতে উঠলেন। তাঁরা শহীদ মিনারে যাবেন। তারপর যাবেন বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে।
বাগমার গতকালই ধানমন্ডির ১৮ নম্বরে বেগম মুজিবের সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। আতিয়াও সঙ্গে ছিলেন।
বেগম মুজিব সব সময়ই আন্তরিক, মেহমানদারিতে কোনো ত্রুটি রাখেন না। কাল ২১ ডিসেম্বর, ১৯৭১, তাকে মনে হয়েছে খুব বেশি দুশ্চিন্তাগ্রস্ত।
বাগমারকে রেনু বলেছেন, শুনেছেন নাকি ভাই, আপনাদের মুজিব ভাইকে নাকি চীনে পাঠায় দিচ্ছে?
বাগমার বলেছেন, না তো ভাবি, শুনি নাই।
কী যে হবে? সারাক্ষণ দুশ্চিন্তা হয়।
বাগমার বলেছেন, ভাবি, দুশ্চিন্তা করবেন না। ৯০ হাজার পাকিস্তানি অফিসার-সোলজার আটক আছে। মুজিব ভাইয়ের কোনো ক্ষতি করার সাহস পাকিস্তানিরা পাবে না। সারা পৃথিবীর সবাই মুজিব ভাইয়ের মুক্তি চায়।
এই সময় একজন বাঙালি মেজর এসেছেন। বেগম মুজিবকে জানিয়েছেন, আপনাকে একটা সুখবর দিতে এলাম। শেখ কামাল আজকেই আসছেন। তিনি আমাদের সেনাপতির এডিসি ছিলেন। তাঁকে প্রটোকল দিয়ে রিসিভ করা হবে।
কামাল আসতেছে–বেগম মুজিব প্রায় চিৎকার করে উঠেছেন।
.
এখন, ২২ ডিসেম্বরে, তেজগাঁও বিমানবন্দরের গাড়িবারান্দায় দাঁড়িয়ে আবদুল আজিজ বাগমারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল ঢাকার এসপি জিয়াউল হক লোদী সাহেবের।