বন্দুক, কামান, ট্যাংকের গর্জন, গুলি-বোমার অস্তিত্ব চুরমার করা আওয়াজ, শ্রুতিকে বধির করা হুংকার, একটু আগে রাসেলকে ফিডারে দুধ খাওয়ানোর ফলে হাতে লেগে থাকা দুধের গন্ধ, সেই গন্ধের সঙ্গে মেশা বারুদের গন্ধ, পেট্রলের গন্ধ, ঘরপোড়া ছাইয়ের গন্ধ–এই সবকিছুর মধ্যে তিনি বসে আছেন মিলিটারি ট্রাকে, যাচ্ছেন অচেনা ব্যক্তিগত গন্তব্যে, আর বাংলার সুনিশ্চিত স্বাধীনতার অনিবার্য গন্তব্যের অনিশ্চিত পথরেখা ধরে। তার মনের মধ্যে অকারণেই এই প্রশ্ন জাগে, নিজের কাছে তিনি কী! এর জবাবে একটুখানি হাসির প্রভা তাঁর উদ্বিগ্ন-ক্লান্ত মুখটাকে প্রসন্ন করে তোলে : কিছুই তো করতে পারলাম না, নীতি ও আদর্শের জন্য সামান্য একটু ত্যাগ স্বীকার করতে চেষ্টা করেছিমাত্র। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির জন্য, নীতি ও আদর্শের জন্য, তিনি একজন সামান্য ত্যাগ স্বীকারকারী মাত্র!
বাংলাদেশ যদি স্বাধীন হয়, যদি কেন, স্বাধীন তো হয়েই গেছে, তার মুখের হাসি উজ্জ্বলতর হয়–লক্ষকোটি বছর ধরে গড়ে ওঠা হিমালয় থেকে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী, মধুমতী বয়ে পলি পড়ে পড়ে গড়ে উঠেছে যে বদ্বীপ, যে বদ্বীপের মানুষেরা চিরটাকাল কেবল শোষিত হয়েই এসেছে, অথচ একদিন যা ছিল সোনার বাংলা, মধুকর ডিঙা নিয়ে লখিন্দরেরা যে বাংলার নদী-সমুদ্র বেয়ে বাণিজ্যতরি নিয়ে ভাসানে যেত, মসলিনে, মসলায়, ধানে, শস্যে যে বাংলা ছিল দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী এলাকা, বিদেশি শোষণে-শাসনে যে সোনার বাংলা শ্মশানে পরিণতপ্রায়, সেই বাংলার জন্য সবচেয়ে বড় অর্জন হবে স্বাধীনতা। বাংলার মানুষ স্বাধীন হবে, বাংলার মানুষ মুক্তি পাবে–হয়তো তিনিই তখন থাকবেন না। তাঁকে যদি হত্যা করা হয়, তাঁকে যেন বাংলার মাটিতে অনন্তশয্যায় শায়িত রাখা হয়। আমার এই মাটিতে জন্ম যেন এই মাটিতে মরি…
বিপরীত দিকে বেঞ্চিতে বসা একজন সৈনিক তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। কোত্থেকে আসা একটা চকিত আলোর ঝলকানিতে তিনি দেখতে পান। সৈনিকটির হেলমেট-ছায়াচ্ছন্ন মুখ। সম্ভবত মুজিবের মুখে হাসি দেখে সে। বিস্মিত। একা একা হাসছে একটা লোক। তা-ও মিলিটারি ট্রাকে সশস্ত্র। শত্রুসৈন্যদের মাঝখানে বসে থেকে, ব্যাপারটা কী! সৈন্যটি কি তাকে পাগল ঠাওরাচ্ছে!
তার দুই পাশে খাকি পোশাক পরা অস্ত্রধারী সৈনিক। বিপরীত দিকেও বেঞ্চিতে সৈন্যরা বসা। এই ট্রাকের সামনের দিকে একটা ভারী অস্ত্র বসিয়ে সদা প্রস্তুত আরেকটা সৈনিক। ওই অস্ত্রটা কী? এলএমজি? রকেট লঞ্চার? শেখ মুজিব তা জানেন না। তার ৫১ বছরের জীবনে কোনো দিন তিনি। অস্ত্রবিদ্যা শিক্ষা করেননি। গোলাবারুদ, বন্দুক, কামান তার অস্ত্র নয়। তার অস্ত্র ন্যায্যতা। তার অস্ত্র মানুষের ঐক্য। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না।
মাঝেমধ্যেই গোলাগুলির শব্দ কানে আসছে। সামরিক কনভয় চলার ভটভট শব্দ ভেদ করে দূর থেকে ভেসে আসছে জনতার চিৎকার। স্লোগান। তাকে বহনকারী গাড়ির সামনে আরেকটা ট্রাক, পেছনে আরেকটা। হেডলাইট নেভানো। শেখ মুজিব পকেট হাতড়ে লাইটার বের করলেন। ব্যথা অনুভব করলেন ডান হাতে। তার বডিগার্ড মহিউদ্দিনের সঙ্গে সৈন্যদের ধস্তাধস্তির সময় মুজিব এগিয়ে গিয়েছিলেন মহিউদ্দিনকে বাঁচাতে। সৈনিকদের একজনের একটা আঘাত তাঁর ডান কাঁধে লেগেছিল। তিনি যখন সিঁড়ি দিয়ে নামছিলেন, তখন সৈন্যরা ছিল ঠিক তার পেছনে। তারা তাদের অস্ত্রের বাট দিয়ে তার পেছনে আঘাত করছিল। সে সময় টের পাননি, এখন পাইপে অগ্নিসংযোগ করতে গিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন, বুড়ো আঙুলে জোর পাচ্ছেন না। তিনি বাঁ হাতে লাইটারটা নিলেন। একজন মেজর বলল, নো লাইট স্যার। নো ফায়ার।
শেখ মুজিব তাদের মনোভাবটা আঁচ করার চেষ্টা করছেন। তারা আলো ভয় পায়। বাংলার মানুষ যদি টের পায় যে এই গাড়িতে তাদের নেতা শেখ মুজিব আছেন, তারা পতঙ্গের মতো ছুটে আসবে। তারা মরবে, তবু শেখ মুজিবকে নিয়ে যেতে দেবে না।
শেখ মুজিব তাঁর কাজ করেছেন। তিনি তাঁর ওয়্যারলেস বার্তা পৌঁছে। দিতে পেরেছেন। হয়তো এই আমার শেষ বার্তা। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। হাজি মোরশেদের কাছে ফোনকল এসেছিল। বলধা গার্ডেন থেকে বলছি, মেসেজ পাঠানো হয়ে গেছে। ইঞ্জিনিয়ার নুরুল হক তাঁর কাজ করেছেন। আশা করা যায়, ওয়্যারলেস যন্ত্র ঠিকঠাক কাজ করেছে। বার্তা প্রচারের পর তারা জানতে চেয়েছে যন্ত্র কী করব? তিনি নির্দেশ দিয়েছেন যন্ত্র ধ্বংস করে পালিয়ে যেতে।
সেনাবাহিনীর এই ট্রাকটা ক্যানভাস দিয়ে ঢাকা। আকাশ দেখা যাচ্ছে না। তার বা পাশে বসা সৈনিকটির মুখ তিনি দেখতে পাচ্ছেন না। কিন্তু ভাবভঙ্গি থেকে অনুমান করা যাচ্ছে যে মুজিবের পাশে সে ঠিকঠাকমতো বসতে পারছে না। সংকোচ বোধ করছে। গাড়ির গতি ধীর। তাকে কোথায় নিয়ে যেতে চায় এরা?
মুজিবের মনে হলো, এরা তাঁকে হত্যা করবে না। তার কাছে খবর ছিল, তিনি যদি পালানোর চেষ্টা করেন, তবে সেই গাড়িতে বোমা মারা হবে। গাড়িতে পলায়নরত অবস্থায় মরে পড়ে থাকবেন, এটা তিনি কল্পনাও করতে পারেন না। তিনি ভেবেছেন, মারলে তাকে বাড়িতেই মারুক। প্রথম দফাতে যখন মারেনি, তখন তাকে আপাতত এরা হয়তো খুন করবে না। ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে গিয়ে সার্জেন্ট জহুরুল হকের মতো পেছন থেকে গুলি করে মারতে পারে কি?