হ্যাঁ। আমিও তো শুনলাম।
৩২ নম্বরের দিকে অনেক গোলাগুলি হয়েছে। জানি না মিয়া ভাই কেমন আছেন। ভাবি কেমন আছে। ছেলেমেয়েগুলান কে কেমন আছে। বেঁচে আছে। নাকি মারা গেছে।
আল্লাহ মাফ করুক। মারা যাবে কেন।
মিয়া ভাই আমাকে বলেছে ভাবি-ছেলেমেয়েদের দেখতে। আমি যাই।
কই যাবা?
৩২ নম্বরে।
কারফিউ না বাইরে?
বড় রাস্তা দিয়া যাব না। গলির ভিতর দিয়া দিয়া যাব।
যাবা যদি, একটা টুপি পরে নাও। আর্মি ধরলে বলবা, নামাজ পড়তে যাচ্ছ।
আচ্ছা। দাও একটা টুপি। ওই যে আলনার বাম দিকে দেখো।
মমিনুল হক খোকা মোহাম্মদপুরের নিউ কলোনি থেকে বের হলেন। এদিক-ওদিক তাকিয়ে ঢুকে পড়লেন লালমাটিয়ার রাস্তায়। আকাশ তখনো অন্ধকার। রাস্তার লাইটপোস্টের ঝুলে থাকা বাল্ব সেই অন্ধকার তাড়াতে পারছে না। আকাশে মেঘ। একটু ঠান্ডা বাতাস বইছে। রাস্তায় কুকুরেরা হল্লা করছে। তিনি একটা গলির ভেতরে ঢুকে গেলেন। পুরো ভুতুড়ে পরিবেশ। কোথাও জনমানুষের কোনো চিহ্ন নেই। খোকা রাস্তা ছেড়ে একটা দেয়াল টপকে একটা বাড়ির ভেতরে ঢুকলেন। তারপর সেই বাড়ির লন উঠান পেছনের বাগান পেরিয়ে আবার টপকালেন আরেকটা প্রাচীর।
এইভাবে এক বাড়ি থেকে আরেক বাড়ি। লালমাটিয়া থেকে এবার যেতে হবে ধানমন্ডি এলাকায়। মধ্যখানে ধানমন্ডি ২৭ নম্বরের বড় রাস্তা। এটা পার হওয়াই কঠিন। তিনি ডানে তাকালেন। বাঁয়ে তাকালেন। রাস্তার একটা জায়গায় বাতি নেই। অন্ধকারটা ওই জায়গায় বেশ গাঢ় হয়ে আছে। ওই জায়গা দিয়েই দ্রুত রাস্তাটা পার হতে হবে তাকে।
দেয়াল টপকে টপকে অন্ধকার জায়গাটায় গিয়ে বড় রাস্তার উত্তর পাশে একটা গাছের আড়ালে আশ্রয় নিলেন খোকা। তার বুকের শব্দ তিনি নিজেই শুনতে পাচ্ছেন। দম নিলেন। ডানে-বায়ে তাকিয়ে দেখলেন, কেউ নেই। এই সুযোগ। আল্লাহর নাম নিয়ে মাথা নিচু করে তিনি এক দৌড়ে রাস্তার দক্ষিণ পাশের বাড়ির সামনে প্রাচীরের ধারে কামিনী ফুলের ঝাড়ের নিচে আশ্রয় নিলেন।
.
ধানমন্ডির বেশির ভাগ বাড়ি এক বিঘা জমির ওপরে। চারদিকে অনুচ্চ পাঁচিল। গাছপালা, বাগান। একতলা বাড়িই বেশির ভাগ। সেসব দেয়াল টপকানো তেমন কষ্টের কিছু নয়। শুধু ভয়, বাড়িতে না আবার কুকুর থাকে! বিওয়্যার অব ডগস দেখলে সেই বাড়ি এড়াতে হবে।
এইভাবে অতিকষ্টে প্রথমে তিনি পৌঁছালেন আহমেদ ফজলুর রহমানের বাসায়। ততক্ষণে আকাশ ফরসা হতে শুরু করেছে। কাকেরা ডাকাডাকি শুরু করে দিয়েছে। খানিকক্ষণ দম নিয়ে খোকা গলি-ঘুপচি, বিভিন্ন বাড়ির কোমর অবধি বানানো দেয়াল, বাড়ির সামনে-পেছনে, চারদিকে বিস্তারিত বাগানের গাছপালার আড়াল ধরে ৩২ নম্বর সড়কে বাহাউদ্দিন সাহেবের বাড়ি গিয়ে পৌঁছালেন। তারা জেগে উঠেছেন।
মিসেস বাহাউদ্দিন ভয় পাওয়া গলায় বললেন, কে?
ভাবি, আমি খোকা। মমিনুল হক খোকা।
আপনি? কই যান?
মুজিব ভাইয়ের বাড়ি যাওয়ার জন্য বের হয়েছি।
ঘরে আসেন। কথা আছে!
মমিনুল হক খোকা এগিয়ে গেলেন। একটার পর একটা পাঁচিল টপকানোর ধকলে তিনি ক্লান্ত এবং ঘর্মাক্ত। মিসেস বাহাউদ্দিনের চোখের নিচে কালি। ঘরে পরা শাড়ির আঁচল সামলাতে সামলাতে তিনি ফিসফিস করে বললেন, খোকা ভাই। রাতের বেলা কামাল এসেছিল। মহিউদ্দিন এসেছিল। দেয়াল টপকে টপকে ভেতর দিয়ে ভেতর দিয়ে এসেছিল। রাতে আমার এখানে ছিল। ভোরবেলা চলে গেল। কোথায় গেল তা তো বলে গেল না!
খোকা খানিকক্ষণ বসলেন। দম নিলেন। মিসেস বাহাউদ্দিন তাকে পানি এনে দিলে তিনি ঢক ঢক করে গেলাস খালি করলেন। তারপর উঠলেন। আবারও দেয়াল টপকে টপকে বড় রাস্তা এড়িয়ে ৩২ নম্বরের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে যাওয়ার অভিযানে নেমে পড়লেন তিনি।
৩২ নম্বর সড়কের ৬৭৭ নম্বর বাড়ির পাশের বাড়িতে এসে পৌঁছালেন মমিনুল হক খোকা। এই বাড়িটা গাছগাছালিতে ঢাকা। আমগাছের নিচে মুকুল ঝরে পড়ে আছে। একটা বুনো ফুলের গন্ধ ভেসে আসছে। এদিক ওদিক তাকালেন তিনি। কোথাও আর্মি-পুলিশ দেখলেন না। আরেকটা দেয়াল টপকে গেলেন মিয়া ভাইয়ের ৬৭৭ নম্বর দোতলা বাড়িটির সামনে। পোড়োবাড়ির মতো পড়ে আছে বাড়িটা। গেট ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন খোকা। এগিয়ে গেলেন। দরজা খোলা। বারান্দা পেরোলেন। ভেতরে উঁকি দিয়ে দেখলেন জিনিসপত্র লন্ডভন্ড। এখানে-ওখানে গুলির খোসা। দেয়ালে গুলির দাগ। বারান্দায় শুকিয়ে যাওয়া রক্তের দাগ।
বাড়িতে কেউ নেই। নিজের পায়ের আওয়াজ নিজেই পাচ্ছেন।
বাইরে এলেন। কবুতরগুলো বাকবাকুম করছে। তাকে দেখামাত্র জামালের কুকুর দুটো ছুটে এল। তার পায়ের কাছে এসে মিনতি করে কী যেন বলতে চাইল। আর দেখতে পেলেন খাঁচার মধ্যে একটা বানর। কাল পুরোটা দিন গেছে, ২৬ মার্চ, এদের কেউ খেতে দেয়নি। খোকাকে দেখে বানরটা কুঁই কুঁই করতে লাগল। তার চোখে মিনতি। খোকা কেঁদে ফেললেন। বাড়িতে কেউ নেই। কে কোথায়? কামাল গিয়েছিল বাহাউদ্দিনের বাড়িতে। সে জীবিত আছে। মিয়া ভাই কোথায়? ভাবিরা কে কোথায়?
পাশের বাসার লোকজনের কাছ থেকে খোঁজ নেওয়া যেতে পারে। তিনি ডা. সামাদের বাড়ির দেয়াল টপকে তাতে ঢুকে পড়লেন। এগিয়ে গেলেন। বাড়ির নিচতলার প্রবেশমুখে। ভেতরে প্রাণের সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।