১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোকেয়া হল থেকে এক মেজর ফোন করেছেন পৌরসভায়। রোকেয়া হলের চারদিকে মানুষের লাশের পচা গন্ধ। বসা যাচ্ছে না। এখনই ডোম পাঠিয়ে লাশ তুলে ফেলা হোক।
সাহেব আলীকে বলা হলো, যাও। রোকেয়া হল এলাকায় যাও। ছয়জন ডোম নিয়ে রোকেয়া হলে গেলেন সাহেব আলী। রোকেয়া হলের রুমগুলোয় তন্ন তন্ন করে খুঁজে কোনো লাশ পেলেন না। চারতলার ছাদের ওপর গিয়ে এক তরুণীর উলঙ্গ লাশ দেখতে পেলেন। সাহেব আলীর সঙ্গে ছিল মিলিটারি সোলজার। সাহেব আলী বললেন, এই ছাত্রীর বডিতে কোনো গুলির চিহ্ন নেই, মাগার মারা ভি গেছে ক্যামনে? সৈন্যটি বিকট শব্দে হেসে উঠল। বোঝে না। আমরা পাকিস্তানিরা এখানে এসেছি তোমাদের কওমের চেহারা বদলে দিতে। আমরা সারা রাত ওকে…
তার দুই দিকের গালে পশুদের কামড়ের চিহ্ন, বুকে দংশনের ক্ষতচিহ্ন। সাহেব আলী একটা রুম থেকে একটা চাদর নিয়ে এলেন। লাশটি ঢেকে দিয়ে নিচে নামালেন। রোকেয়া হলের সার্ভেন্ট কোয়ার্টারের ভেতরে ঢুকে দেখলেন, পাঁচজন নারীর লাশ আর আটজন পুরুষের লাশ পড়ে আছে। লাশ দেখে মনে হলো মৃত্যুর আগে সবাই বিছানায় শুয়ে ছিল। ডোমরা সেই লাশগুলো তুলল।
তারা ট্রাক নিয়ে গেলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিববাড়ির সামনে। তিনতলায় অধ্যাপকের কোয়ার্টার। চারটা লাশ পড়ে আছে। সাহেব আলীর মনে হলো, এসব হিন্দু অধ্যাপক, তাঁর স্ত্রী ও দুই ছেলের লাশ। আশপাশের লোকেরা ফিসফিস করে বলল, তার দুই মেয়ে বুলেটবিদ্ধ হয়ে হাসপাতালে আছেন।
লাশগুলো স্বামীবাগ আউটকলে ফেলে দিয়ে তারা ট্রাক নিয়ে চললেন বুড়িগঙ্গা নদীর ধারে। ভাসমান হাত-পা, চোখবাধা অসংখ্য যুবকের লাশ পানিতে ভাসছে। ৩০ মার্চ বুড়িগঙ্গা নদী থেকে তিন ট্রাক লাশ তুলে স্বামীবাগ আউটকলে ফেলেছে সাহেব আলীর দল। পাকিস্তানি সেনারা শ্রমিক লাগিয়ে আগেই সেখানে বিরাট বিরাট গর্ত করে রেখেছিল। ৩১ মার্চ সাহেব আলীর দল মোহাম্মদপুর এলাকার জয়েন্ট কলোনির কাছ থেকে সাতটা পচা-ফোলা লাশ তুলল। ইকবাল হলে কোনো লাশ পাওয়া গেল না। পাওয়া গেল লাশপোড়া ছাইভস্ম। পাকিস্তানি সেনারা আগেই ইকবাল হলের লাশ পেট্রল দিয়ে জ্বালিয়ে ভস্ম করে দিয়ে রেখেছে। তারা আরও দশটা লাশ তুলেছে জগন্নাথ হল এলাকায়। সাহেব আলীর মনে হয়েছে, এরা বস্তি এলাকা থেকে জগন্নাথ হলে আশ্রয়ের জন্য ছুটে এসেছিল। কিন্তু বাঁচতে পারেনি।
ফেরার পথে ঢাকা হলের ভেতর থেকে চারজন ছাত্রের উলঙ্গ লাশ তুললেন তারা। ১৯৭১ সালের ১ এপ্রিল কচুক্ষেত, ড্রাম ফ্যাক্টরি, তেজগাঁও, ইন্দিরা রোড, দ্বিতীয় রাজধানী এলাকার ঢাকা বিমানবন্দরের ভেতরের এলাকায়, ঢাকা স্টেডিয়ামের মসজিদের পূর্ব-দক্ষিণ দিক থেকে কয়েকটা পচা লাশ তুলেছিলেন।
এরপর প্রতিদিন তাদের তুলতে হয়েছে লাশ। প্রতিদিন। বুড়িগঙ্গা নদীর পাড় থেকে হাত-পা, চোখবাধা অসংখ্য মানুষের লাশ তাঁরা তুলতেন। মোহাম্মদপুর ফিজিক্যাল কলেজের হল থেকে ১০ জন ছাত্রের ক্ষতবিক্ষত লাশ তুলেছেন। রায়েরবাজার রাস্তা, পিলখানা, গণকটুলী, ধানমন্ডি, কলাবাগান, কাঁঠালবাগান, এয়ারপোর্ট রোডের পার্শ্ববর্তী এলাকা, তেজগাঁও মাদ্রাসা থেকে অসংখ্য মানুষের পচা-ফোলা লাশ তাদের তুলতে হয়েছে। তার মনে থাকবে যে অনেক লাশের হাত-পা পেয়েছিলেন, মাথা পাননি। মেয়েদের লাশগুলো ছিল উলঙ্গ ও ক্ষতবিক্ষত।
একদিন তাকে হুকুম করা হলো সাধনা ঔষধালয়ে যেতে হবে। লাশ সরাতে হবে। সাহেব আলী ডোমদের নিয়ে গেলেন স্বামীবাগের সাধনা ঔষধালয়ের কারখানায়। গিয়ে দেখতে পেলেন, ঔষধালয়ের মালিক প্রফেসর যোগেশ চন্দ্রের লাশ। বেয়নেটের আঘাতে ক্ষতবিক্ষত রক্তাক্ত তাজা লাশ তুলে কাঁদতে কাঁদতে তারা স্বামীবাগ ফেলে দিয়ে এলেন। যোগেশবাবুর লাশ জিব বের করে হাঁ হয়ে ছিল। গায়ে ছিল ধুতি আর গেঞ্জি।
রাতের বেলা বড় বউয়ের কাছে গিয়ে সাহেব আলী হাঁসফাঁস করেন। ছোট বউয়ের কাছে এলেও ঘুমাতে পারেন না। উঠে বসে থাকেন।
ছোট বউ বলেন, কী হইল আপনার। তড়পান ক্যান?
সাহেব আলী কথা বলেন না।
ও গো। তোমার হইছেটা কী? আমারে কও।
সাহেব আলী বলেন, বিবি, লাশ।
আরে মরার কথা হুনো। তুমি সুইপার। ডোম গো লইয়া তোমার কাম। তুমি লাশ দেখবা না।
সাহেব আলী কাঁদতে থাকেন, লাশ আর লাশ। মরদ পোলার লাশ, জোয়ান পোলার লাশ, যুবতী মাইয়া গো উলঙ্গ লাশ। লাশে লাশে নদীর পানি পুরা ঢাইকা রইছে। পানি দেখা যায় না। খালি লাশ আর লাশ। জন্তু জানোয়ারের না। মাইনষের লাশ…।
বউ নরম হন, কাইন্দেন না গো। কাইন্দেন না। আল্লাহর কাছে বিচার দ্যান। আল্লাহ বিচার করব। আল্লাহ বিচার করব।
৮
মমিনুল হক খোকা মোহাম্মদপুরের বাসায় বিছানা ছেড়ে উঠে পড়লেন শেষ রাতে। ক্যালেন্ডারে তখন ২৭ মার্চ ১৯৭১। তাঁর স্ত্রী মমতাজও ঘুমাতে পারছিলেন না। এই রাতে ঘুমানো যায়?
উঠে পড়লা যে? মমতাজ অন্ধকারের মধ্যে জ্বলতে থাকা টেবিলঘড়ির রেডিয়াম কাটার দিকে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন কটা বাজে।
ঘুমাতে পারছি না। অস্থির লাগছে। খোকা বিছানায় বসে দুই পা মেঝেতে রেখে বললেন।
আমারও ভালো লাগছে না। বুকটা কাঁপছে।
কাল রাতে বিবিসিতে বলল, মিয়া ভাই স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।