বউ বললেন, করেন কী! কই যান?
সাহেব আলী বললেন, কোথাও যামু না। ঘটনা কী, মালুম কইরা আহি।
সাহেব আলী একটু একটু করে এগোচ্ছেন। জনতা চিৎকার করছে জয় বাংলা। গলির মুখে দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন, পুরা ঢাকার রাতের আকাশ আগুনে দাউ দাউ করে জ্বলছে। তার মনে হলো, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, মালিবাগ গোয়েন্দা অফিস, বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়িতে ভীষণ গোলাগুলি হচ্ছে। আর সব বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে।
সাহেব আলীর শরীর কাঁপতে লাগল। তিনি সুইপার কলোনির দোতলায় গেলেন। বড় বউ আর ছেলেপুলেদের বললেন, হুঁশিয়ার থাকো। সবাই মাটিতে শুইয়া থাকো।
আপনেও আহেন। আল্লার দোহাই লাগে, বাইরে যায়েন না।
না। যামু না। একটু বুঝার চেষ্টা করি, কুনহানে কী হইবার লাগছে।
সারা রাত মেঝেতে শুয়ে থেকে কিয়ামতের প্রলয়কাণ্ডের খানিকটা টের পেলেন। শব্দ, আগুন, চিৎকার। ঘুমাতে পারলেন না। এর মধ্যে ছোট ছেলেটা বারবার করে কেঁদে উঠছে। ডর লাগে। ডর লাগে। তার মা তাকে বুকের মধ্যে ঠেসে ধরে থাকেন।
ভোর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সাহেব আলী বের হলেন। বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির দিক থেকে রাতে অনেক গোলাগুলির শব্দ এসেছিল। দেখে আসা দরকার। ফাঁড়ির পুলিশদের সঙ্গে তাঁর বিশেষ খাতির। রোজ রাতে ডিউটি করার সময় তাদের সঙ্গে দেখা হয়। লাশ উদ্ধার করে মর্গে নেওয়ার সময়ও সাহেব আলীদের ডাক পড়ে।
অন্ধকার কেটে যাচ্ছে। পুবের আকাশ ফরসা হচ্ছে। পুরান ঢাকার গলির মধ্যে হোটেলগুলোর ছাদে কাক ভিড় করে হল্লাচিল্লা করতে শুরু করেছে। কুকুরের দল ছোটাছুটি করছে অকারণে। বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির দৃশ্য না দেখাই ভালো ছিল। ১০ জন ইউনিফর্ম পরা পুলিশ পড়ে আছে। তাদের শরীর ক্ষতবিক্ষত। রক্তাক্ত। সেই রক্ত শুকিয়ে কালো হয়ে গেছে। মেঝেতে রক্ত। চেয়ারে-টেবিলে রক্ত। দেয়ালে গুলিতে ঝাঁঝরা।
সাহেব আলী জানেন না যে বাইরে কারফিউ। তিনি তাঁর সহকর্মীদের ডাকলেন। ঠেলাগাড়ি আনালেন। লাশগুলো তুললেন ঠেলাগাড়িতে। ঠেলে নিয়ে গেলেন মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানকার লাশঘরে স্তূপ করে রাখলেন মানুষের মৃতদেহ।
শাঁখারীবাজারে এলেন। রাস্তায় লাশ পড়ে আছে। রিকশার পাশে পড়ে আছে রিকশাওয়ালার গুলিবিদ্ধ মৃতদেহ। রাস্তার ধারে হাতে ভিক্ষার থালা ধরে পড়ে আছে ভিখারির পা না-থাকা দেহ। জজকোর্টের কোনায় হোটেল রেস্টুরেন্টের সামনে পড়ে আছে লাশ। সব গুলিবিদ্ধ। সুইপারদের সঙ্গে মহল্লাবাসী তরুণ-যুবক-ছাত্ররাও এসে হাত লাগাল। তারা লাশ তুলে রাখলেন। ঠেলাগাড়িতে নিয়ে নামিয়ে দিয়ে এলেন হাসপাতালের লাশঘরে।
রাস্তায় জনতার ভিড় বাড়তে থাকল। এবার মাইকে ঘোষণা আসতে লাগল–কারফিউ। সেনাবাহিনীর গাড়ি অস্ত্র উঁচিয়ে আসতে লাগল পুরান ঢাকাতেও। সাহেব আলী রাস্তা থেকে সরে পড়লেন। সুইপার কলোনিতে গেলেন। গোসল সেরে নিলেন। বিকেল ৫টার দিকে দেখতে পেলেন, তাঁতীবাজার, শাঁখারীবাজার, কোর্ট হাউস এলাকায় মিলিটারিরা সার বেঁধে অস্ত্র উঁচিয়ে যাচ্ছে আর গুলিবর্ষণ করছে নির্বিচার, ফায়ারগান দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে সামনে যা পাচ্ছে তাতেই। সারা রাত গুলিবর্ষণ চলল। চলল। আগুন লাগানো। রাতের পুরান ঢাকা জ্বলে-পুড়ে অগ্নিকুণ্ড হয়ে গেল। দোজখেও এত আগুন আছে কি না, সাহেব আলীর মনে সন্দেহ।
২৭ মার্চ বেলা একটায় নবাবপুর রোড, ইংলিশ রোডের দোকানে দোকানে আগুন দিতে লাগল মিলিটারিরা। মানুষ ছুটে পালাতে লাগল আগুনের দাহ থেকে বাঁচতে। অমনি চলল গুলি। তাঁতীবাজারের কাছের মন্দিরে শেল বর্ষণ করে সেটাকে গুঁড়িয়ে দিল আর্মিরা।
আগুন ছড়িয়ে পড়ছে। ইংলিশ রোডের আগুন ঘরবাড়ি, দোকান পুড়িয়ে এগিয়ে আসছে সুইপার কলোনির দিকে। সাহেব আলী সব সুইপারকে নিয়ে পানি জমাতে শুরু করলেন। কিন্তু একটু পরে মিলিটারি এদিকায় এসে গুলিবর্ষণ করতে শুরু করলে নারী-পুরুষ-শিশু সবাই পালাতে শুরু করল।
২৮ মার্চ। রেডিওতে ঘোষণা আসছে, সব সরকারি কর্মচারীকে যোগ দিতে হবে কাজে।
২৯ মার্চ কাল ১০টার সময় ঢাকা পৌরসভা অফিসে গিয়ে ডিউটি রিপোর্ট করলেন সাহেব আলী। কনজারভেন্সি অফিসার ইদ্রিস বললেন, সাহেব আলী। ডোমদের নিয়ে বার হও। রাস্তায় রাস্তায় লাশ পইড়া আছে। চায়া আছ। ক্যান। সাহেব আলী, বাইর হয়া পড়ো, বাঁচবার চাও তো বারায়া পড়ো। কেউ বাঁচব না, তুমি না আমি না। কাউরে রাখা হইব না, সবগুলানরে কুত্তা বিলাইয়ের লাহান মাইরা ফেলা হইব।
পৌরসভার চেয়ারম্যান মেজর সালামত আলী খান। তার গলার স্বর আরও চড়া। মেজাজ কামানের মতো গরম। এই হারামজাদারা, চেয়ে আছ। কেন? বের হও। নিকলো, বাহার যাও।
সাহেব আলী বের হলেন। সুইপার ইন্সপেক্টর আলাউদ্দিন, সুইপার ইন্সপেক্টর কালীচরণ, সুইপার সুপারভাইজার পাঞ্চাম, সুইপার ইন্সপেক্টর আওলাদ হোসেন–পাঁচজন অফিস থেকে বের হলেন। সাহেব আলীর ডিউটি পড়ল ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতাল থেকে লাশ তুলে স্বামীবাগ আউটফলে ফেলার। তিনি পরদেশি ডোম, মন্টু ডোম, লেমু ডোম, গোলাপ চান ডোম, দুঘিলা ডোম ও মধু ডোমকে নিয়ে কাজে লেগে পড়লেন। ২৯ মার্চ ১৯৭১। সাহেব আলীর দল লাশ তুলছে। যেমন করে ঢাকার সোয়ারীঘাটে সকালবেলা ট্রাকে ট্রাকে ইলিশ মাছ আসে, একসঙ্গে ডালা ভরে মাছ নামানো হয়, ট্রাকে রিকশায়-ভ্যানে তোলা হয়, তেমনি করে ঢাকা মিটফোর্ড হাসপাতালের লাশঘর থেকে সাহেব আলী অন্য ডোমদের নিয়ে লাশ বের করে করে ট্রাকে তুলতে লাগলেন। মানুষের লাশ। দুই ট্রাক লাশ তারা তুললেন। সাহেব আলী একটা করে লাশ তুলছেন, আর বোঝার চেষ্টা করছেন, এঁরা কে কী করতেন। তার মনে হলো, কেউ সরকারি কর্মচারী। পুলিশ, আনসার ও পাওয়ারম্যানদের খাকি পোশাক পরা লাশগুলো এরই মধ্যে বিকৃত হয়ে গেছে। লাশ তুলতে তুলতে পরদেশি ডোমের হাতে এক কিশোরীর লাশ উঠল। সম্পূর্ণ নগ্ন। তার শরীরে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন, তার বুক থেকে স্তন কেটে তুলে নেওয়া হয়েছে, লজ্জাস্থান ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে, নিতম্বের মাংসও কাটা। এরপর আরেকটা নগ্ন ক্ষতবিক্ষত শরীর। বছর দশেক বয়সী একটা বালিকার উলঙ্গ ক্ষতবিক্ষত লাশ। সারা দেহে বুলেটের আঘাত।