পাশের বাড়িটি মুবিন সাহেবের। এর আগে পরিচয় হয়নি লিলির। বাড়ির পেছনের দিকে দেয়ালের পাশে আসতেই দেখা গেল ওই বাড়ির লোকজন তাদের সাহায্য করার জন্য সবাই উপস্থিত। এ পাশে উঁচু টুল পাতা হলো। ও পাশে মই। আতিয়া সাহায্য করলেন এই পারে। ওই পারে মুবিন সাহেব বললেন, মা, সাবধানে পার হও। তাড়াহুড়া নেই। রাস্তা থেকে জায়গাটা দেখা যাচ্ছে না।
.
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি বলবে :
এই মুবিন সাহেব হলেন সিলেটের মানুষ, আবদুল মুবিন চৌধুরী। তাঁর ছেলে শমসের মুবিন চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধে যাবেন, বীর বিক্রম খেতাব অর্জন করবেন। সে-ও তো যুদ্ধদিনের কথা, যুদ্ধ শেষের কথা।
.
ব্যাঙ্গমা আর ব্যাঙ্গমি স্মরণ করবে :
৩২ নম্বরে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যদের হাতে নির্যাতিত ও আটককৃত অচেতন হাজি মোরশেদকে প্রথমে সংসদ ভবনের সিঁড়িতে, তারপর আদমজী স্কুলের রুমে রাখা হয়, তারপর নিয়ে যাওয়া হয় কেন্দ্রীয় সামরিক হাসপাতালে। আবদুল আজিজ বাগমারসহ তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ি থেকে ধরে আনা লোকদের প্রথমে সংসদ ভবনের সিঁড়ি, তারপর ক্যান্টনমেন্টের কচুক্ষেত এলাকার একটা গুদামে এনে ঢোকানো হলো। ওইখানে সার বেঁধে ৫টা গুদাম। গুদামের গেটে লেখা : পি ডব্লিউ কেইজ। প্রিজনার্স অব ওয়ার কেইজ। তার আগে তাদের মেরে-পিটিয়ে রক্তাক্ত, ক্ষতবিক্ষত করা হয়। এই খাঁচাতেও তাঁদের ওপরে চলে নিয়ম করে ভয়াবহ শারীরিক নির্যাতন। মোহাম্মদপুর থানার বাঙালি পুলিশদেরও আনা হয়েছিল একই খাঁচায়। মারতে মারতে তাদের মেরেই ফেলা হয়েছিল। এর মধ্যে হাসপাতাল থেকে বের করে এনে হাজি মোরশেদকেও এই হায়েনার খাঁচায় এনে পোরা হলো। তাজউদ্দীন আহমদের বাড়িতে ধরা পড়া আবদুল আজিজ বাগমারের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর বাড়ি থেকে ধরা পড়া হাজি মোরশেদের।
হাজি মোরশেদ দুর্বল শরীরে অস্ফুট স্বরে বললেন, মুজিব ভাইকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে।
বাগমার ফিসফিস করে বললেন, তাজউদ্দীন ভাই মিলিটারি আসার আগে আগেই আমীর-উল ইসলাম, কামাল হোসেনের সঙ্গে গাড়ি করে বাড়ি ছেড়েছেন। কোথায় আছেন, কেমন আছেন–আর কিছু জানি না।
হাজি মোরশেদ কাতর কণ্ঠে বললেন, আমাকে পিটিয়ে তো শেষ করে ফেলেছে। আরও নির্যাতন নিশ্চয়ই করবে।
বাগমার ব্যথিত গলায় বললেন, আমাদেরও অমানুষিক নির্যাতন করছে।
হাজি মোরশেদ চোয়াল শক্ত করে বললেন, বাগমার ভাই, আমাকে মেরে ফেললেও আমি স্বীকার করব না যে আমি আপনাকে চিনি। আপনিও কোনো কিছু স্বীকার করবেন না। দোয়া করি যেন বেঁচে থাকেন।
বাগমারও দৃঢ়কণ্ঠে বললেন, আপনার জন্য আমি অন্তর থেকে দোয়া করি। আপনার এই কথা যে আমাকে কত সাহস দিল, আপনাকে বোঝাতে পারব না।
৭
ব্যাঙ্গমা বলল, ২৫ মার্চ থাইকা পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢাকাসহ সারা বাংলায় দোজখের আগুন ছড়ায়া দেয়।
ব্যাঙ্গমি বলল, ট্যাংক, কামান, মর্টার, এলএমজি, মেশিনগানের অবিরাম তোেপবর্ষণ, ছাত্রাবাস, বস্তি, পুলিশ ব্যারাক, ইপিআর ঘাটি, আনসার ঘাঁটি, লোকালয়, জনপদে অগ্নিসংযোগ আর নির্বিচার মানুষ হত্যা। তালিকা ধইরা ধইরা ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবী স্বাধীনতাকামী মানুষের ঘরে ঘরে গিয়া গুলি কইরা হত্যা। জগন্নাথ হল থাইকা ছাত্রদের ধইরা আইনা মাঠে লাইন কইরা দাঁড় করায়া ব্রাশফায়ার। গর্ত কইরা সব লাশ চাপা দেওয়া মাটির তলায়। এই সবের বর্ণনা কি শেষ করা যায়! কারও পক্ষে সম্ভব পুরা নরকের ছবিটা আঁকা? ভাষায় ধারণ করা?
ব্যাঙ্গমা বলে, ২৫ মার্চ রাইতের হত্যা, ধর্ষণ, মৃত্যু, আগুন, গোলাবর্ষণের বিবরণ কারও পক্ষেই কুনুদিনও দেওয়া সম্ভব হইব না।
ব্যাঙ্গমি বলে, কারও পক্ষেই কুনুদিন সম্ভব না। আমরা এক কাম করতে পারি। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ : দলিলপত্র বইয়ের অষ্টম খণ্ড থাইকা ঢাকা মিউনিসিপ্যালিটির সুইপার ইন্সপেক্টর সাহেব আলীর বিবরণ অবলম্বন করার লাইগা তারে ফলো করতে পারি।
.
সাহেব আলী সুইপারদের ইন্সপেক্টর। রাতে আছেন প্রসন্ন প্রসাদ লেনে তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রীর বাড়িতে। সন্ধ্যার দিকে বেরিয়েছিলেন ডিউটিতে। রাতের বেলা ঢাকা শহরের রাস্তা ঝাড়ু দেওয়া তাদের কাজ। তিনি ইন্সপেক্টর। নিজের হাতে ঝাড় দিতে হয় না। তার দলের লোকেরা ঝাড়ু দেয়। তিনি দেখভাল করেন। মুখে একটা পান পুরে ২৫ মার্চ সন্ধ্যাতেও ডিউটি সেরেছেন। রাস্তায় জনতা ব্যারিকেড দিয়েছে। হাজার হাজার মানুষ পুরান ঢাকার রাস্তা দখল করে রেখেছে। রাত নয়টার পর পরিস্থিতি থমথমে হতে লাগল। সাহেব আলী জানতে পারলেন, পাকিস্তানি মিলিটারি রাতে হামলা করতে পারে। তাই জনতা বেশি করে ব্যারিকেড দিচ্ছে। আলোচনা ভেঙে গেল। সাহেব আলী মন খারাপ করে এসেছেন ছোট বউয়ের কাছে।
ঠিকমতো খেতে পারলেন না। ছোট বউ যত্ন করে মুরগির গোশত দিয়ে বুটের ডাল বেঁধেছেন। নিজ হাতে আটা ছেনে বেলনা দিয়ে বেলে রুটি বানাচ্ছেন আর গরম-গরম তার পাতে তুলে দিচ্ছেন। কিন্তু সাহেব আলীর হাত রুটি ছিঁড়তে পারছে না।
বউ বললেন, কী হইল। কার কথা ভাবেন? বড় বউয়ের কথা?
সাহেব আলী বললেন, কিছু জিগাইলা? মনটার মধ্যে কু-ডাক দিতাছে। আজ রাইতে না জানি কী হয়!
খানিক পরেই গোলাগুলির শব্দ শুরু হলো। সাহেব আলী বাড়ি থেকে বের হলেন।