লিলি বাইরের দিকে অঙ্গুলিনির্দেশ করলেন। রাস্তার ওপরেই মিলিটারি প্রহরা। ওই বাড়ির দেয়াল অনেক উঁচু। সেটা পার হওয়া অসম্ভব। আর গেট দিয়ে বের হওয়ামাত্র পড়তে হবে মিলিটারির কবলে। হঠাৎ লিলির চোখে পড়ল তাদের বাসার একটা জানালার সানশেডের ওপরে। ও মা! একি! একটা ওয়্যারলেস বসিয়ে রেখে গেছে মনে হচ্ছে। সব কথা এখান থেকে চলে যাচ্ছে মিলিটারির কাছে?
এই ভোরবেলাতেই লিলি একটা কাজ করিয়েছেন দিদারকে দিয়ে। তার যত ছবি ছিল ঘরের দেয়ালে, সব কটি সরিয়ে দিয়েছেন।
লিলি আবার দোতলায় গেলেন। যাওয়ার আগে নিজের ঘরের শূন্য দেয়ালের দিকে তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। পা এখনো পুরোপুরি সারেনি। একটু কষ্টই হয় সিঁড়ি ভাঙতে।
দোতলায় গিয়ে ডাইনিংয়ে একটা চেয়ারে বসলেন লিলি। আতিয়াও এসে পাশের চেয়ারে বসলেন। তাকে দেখাচ্ছে ছিন্নভিন্ন। হাবিব সাহেবরা কিংকর্তব্যবিমূঢ়। হঠাৎ দরজায় ধাক্কা আর কলবেলের কর্ণবিদারী শব্দ। বাইরে গাড়ির আওয়াজ। বুটের খটখট পিলে চমকানো শব্দ।
লিলির আব্বা সেরাজুল হক সাহেব দরজার কাছে গেলেন। তারা তাকে হুকুম করল, বাড়ির ছাদে কালো পতাকা কেন, পতাকা নামাও।
সেরাজুল হক সাহেব ভদ্রভাবে বললেন, জি। কালো পতাকা নামানো হবে।
মিলিটারিরা চলে গেল। দিদার ছুটল পতাকা নামাতে। পতাকা নামিয়ে দিদার ট্রে-ভর্তি খাবার নিয়ে এসেছে দোতলায়। ঘড়িতে তখন আটটা। লিলি ধমক দিলেন, এই তুই ক্যানো খাবার নিয়ে ওপরে উঠেছিস। আমরা তো দোতলার ভাড়াটে। নিচতলার সাথে আমাদের কোনো সম্পর্ক নেই। লিলি বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, তিনি উর্দুতে কথা বলছেন। দিদার এই উর্দুর কিছুই না বুঝে হাঁ করে তাকিয়ে আছে। আগের রাতে একটা আকিকার দাওয়াত ছিল। সেখানে যাওয়ার প্রশ্নই ছিল না। কিন্তু মেজবানরা খাবার পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। সেই খাবার সেরাজুল হক সাহেব ওপরে পাঠিয়েছেন।
কে খাবে খাবার? কার গলা দিয়ে এখন খাবার নামবে? খাবার পড়ে রইল টেবিলে। টেবিলের পাশে বসে আছেন আতিয়া। তার শরীর এলায়িত। একরাশ হতাশা মেঘের মতো ছেয়ে রেখেছে মুখখানা। বসে আছে মিমি। সোহেল লিলির কোলে। চেয়ারে গা এলিয়ে বসে আছেন হাবিব আর তাঁর স্ত্রী। কেউই খাচ্ছেন না।
টেবিলের ওপরে একটা রেডিও। তাতে একটা কাপড়ের ঢাকনা। লিলি রেডিওর নব ঘোরাতে লাগলেন। ঢাকা কেন্দ্র বন্ধ। নব ঘুরিয়ে এ কেন্দ্র ও কেন্দ্র ছুঁড়ে শোনা গেল বিকৃত বাংলা। তার মানে হলো, কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যায়নি। উর্দুওয়ালাদের ধরে এনে রেডিও চালানোর চেষ্টা চলছে।
আতিয়া বললেন, ভাবি, আজিজ কখন ফিরবে?
কে জানে এই প্রশ্নের উত্তর। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকাল আটটার সময় কার কাছে এই প্রশ্নের উত্তর আছে যে ২৫ মার্চ রাতে যাকে ধরা হয়েছে, সে কবে ছাড়া পাবে পাকিস্তানিদের দোজখখানা থেকে?
লিলি বললেন, কারফিউ আর কতক্ষণ। কারফিউ তুলে নেবে। আর আজিজও চলে আসবে। ভেবো না আতিয়া।
আতিয়া বললেন, ফিরে আসবে, না? আসেন তাহলে নাশতা খাই।
আতিয়া হাসলেন। প্রত্যুত্তরে হাসলেন লিলিও। তাঁরা জানেন পরস্পর পরস্পরকে ঠকাচ্ছেন। নিজের অন্তরকেও প্রবোধ দিচ্ছেন। তারা নাশতা খেতে আরম্ভ করলেন।
লিলির মনে হলো, কাল রাতে তিনি তাজউদ্দীনের জন্যও টেবিলে খাবার বেড়ে রেখেছিলেন। প্লেট সাজিয়েছিলেন। তা না খেয়েই চলে গেছেন। তাজউদ্দীন।
আবার রেডিওর বোতাম ঘোরাচ্ছেন লিলি। এবার শোনা গেল আকাশবাণী কলকাতা। তারা বলছে, পূর্ব পাকিস্তানে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। ভয় নেই। ভারত আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে।
ভয়ে, উত্তেজনায়, উদ্বেগে, উৎকণ্ঠায় দুপুর গড়িয়ে এল বিকেল। লিলি এবার উঠে দাঁড়ালেন। তিনি মনস্থির করে ফেলেছেন। আর এই বাড়িতে থাকা নয়। তাঁকে পালাতেই হবে। তিনি নিচে গেলেন। আবার চারপাশটা ভালো করে খেয়াল করে দেখতে লাগলেন।
পাশের বাড়ির সাকিবার আব্বাও বারান্দায়। মিসেস তাজউদ্দীনকে দেখে তিনি অনুচ্চ স্বরে ডাকলেন, ভাবি, ভাবি, আপনি আমাদের বাসায় চলে আসেন।
লিলি একটা মুহূর্ত নিলেন ভেবে নেওয়ার জন্য। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বাড়িতে আর্মি আবার আসবে। এখানে থাকা কিছুতেই নিরাপদ না।
তিনি উঠলেন দোতলায়। আতিয়াকে ডেকে বললেন, আতিয়া। আমি সাকিবাদের বাড়ি যাই। তোমার নিজেরই বিপদ। আমি থাকলে বিপদ বাড়বে বৈ কমবে না। নিচে আব্বা আছেন। তিনি তোমার দেখাশোনা করবেন।
আতিয়া কেবল এই প্রস্তাবে সায় দিলেন তা-ই নয়, একটুখানি গোছগাছ করে নিতে সাহায্য করলেন লিলিকে। লিলির কোলে সোহেল, আতিয়ার কোলে মিমি। তারা নিচে নামলেন।
লিলি গেলেন তার আব্বার ঘরে। তাঁর পিতা স্তব্ধ হয়ে বসে আছেন। লিলি বাবাকে কদমবুসি করলেন। বললেন, আব্বা, আমি পাশের বাসায় যাচ্ছি।
সেরাজুল হকের চোখের নিচে পিঁচুটি। গলায় শ্লেষ্ম জমে গেছে। ঘর্ঘরে গলায় তিনি বললেন, কারফিউ তো। কীভাবে যাবি?
রাস্তা দিয়ে যাওয়া যাবে না। দেয়াল টপকাব।
মিলিটারি দেখলে গুলি করবে।
সাবধানে যাব। যখন দেখব রাস্তায় আর্মির গাড়ি নাই, তখন দেয়াল টপকাব।
লিলি আর সময় নেবেন না। দ্রুত আব্বার সামনে থেকে সরে যেতে হবে। না হলে মায়া এসে জড়িয়ে ধরবে। আব্বা এখানে কার সঙ্গে থাকবেন? কে তাকে খাবার দেবে? বিপদে-আপদে কে তাকে দেখবে, এসব কথা ভাবতে গেলেই পা আটকে যাবে শিকলে। আগে সটকে পড়তে হবে। পরের চিন্তা পরে।