আতিয়ার মনে ভয়, ওই ওপাশের টেবিলের কাগজে বাগমার বোমা বানানোর ফর্মুলা ইংরেজিতে লিখে রেখেছেন। সেদিকে না নজর যায়। সৈন্যদের নজর গেল দেয়ালে ঝোলানো রবীন্দ্রনাথের ফটোর দিকে। এই বুঝি সবাই ধরা পড়ে যান যে এরা উর্দুভাষী নন। কমান্ডার প্রশ্ন করল, ইয়ে কৌন হ্যায় জি?
আতিয়া জবাব দিলেন, ও হামারি পীর ছাহেব হ্যায়। মগর জিন্দা নেহি হ্যায়। কমান্ডার ডান পা তুলে মেঝেতে বুট ঠুকে স্যালুট করল পীর সাহেবকে।
আর্মিরা ওপর থেকে টেনেহিঁচড়ে নামাল আজিজ বাগমারকে, লিলুকে, তাঁদের বাবুর্চি আবদুলকে। নিচের তলা থেকে তফাজ্জল, হাসান, বারেক মিয়াকে বন্দুকের মুখে এক জায়গায় জড়ো করল। বালক দিদারকে তারা ছেড়ে দিল। আর ছেড়ে দিল লিলুকে। বাচ্চে তুম উপর ওয়াপস চলে যাও। লিলুও বুঝে ফেলল, বাংলায় কথা বলা যাবে না। সে চাচাকে চোখের ভাষায় জিজ্ঞেস করল ওপরে যাবে কি না। বাগমার তাকে ইশারা করলেন ওপরে যেতে।
বাকিদের তারা বন্দুকের বাড়ি দিতে দিতে তুলে ফেলল ট্রাকে। বাগমার ট্রাকে উঠলেন।
বিকট শব্দ হলো। একটা গুলি তাঁর মাথার পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তাঁর ঝকড়া লম্বা চুলের অনেকটা পুড়িয়ে উড়িয়ে নিয়ে চলে গেল। চুলপোড়া গন্ধ বেরোতে লাগল।
আতিয়ার অশ্রুসিক্ত দৃষ্টি গিয়ে পড়ল ফ্লেয়ারের আলোয় হঠাৎ ঝলসে ওঠা আবদুল আজিজ বাগমারের উদ্বিগ্ন মুখে।
আতিয়া কাঁদতে লাগলেন শব্দ করে। চারদিকে গোলাগুলির আওয়াজের মধ্যে সেই কান্না হারিয়ে গেল মহাকালের অতলে।
দিদার রিমিদের নানার ঘরে গেল। দেখল, ভয়ার্ত নানা তখনো জোরে জোরে পাঠ করে চলেছেন, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু…
.
সময় পাথর হয়ে জমে থাকে। সময় অগ্নিকুণ্ড হয়ে জ্বলে। সময় আগ্নেয়গিরির লাভার মতো বয়েও যায়। লিলি জানেন না কী করে ২৫ মার্চ রাতটা কেটে গিয়ে ২৬ মার্চের ভোর এল। কামানের গর্জন, মর্টারের গোলা। আগুন, বারুদ, বিস্ফোরণ। সমস্ত আকাশ কাল রাতে পুড়ে গেছে। কাল রাতের আকাশ ছিল গনগনে জ্বলন্ত গলন্ত লোহার মতো লাল। ভোরবেলায়। গোলাগুলির শব্দ একটু কমে এসেছে। রাস্তায় মিলিটারি ট্রাক, মিলিটারি জিপ মাইক লাগিয়ে ঘোষণা করছে অনির্দিষ্টকালের জন্য কারফিউ। লিলি একবার। ঘুমন্ত মিমির দিকে তাকালেন। ওর কপালে ঘাম, জানালা গলে আসা আলোয় দেখা যাচ্ছে ঘামের মধ্যে ওর পাতলা চুল আটকে আছে। সোহেলের এক হাত শরীরের নিচে চাপা পড়ে আছে, তিনি বাচ্চাটাকে আলতো করে ধরে হাতটা মুক্ত করে নিলেন। রিমি, রিপি ভাগ্যিস এই বাড়িতে নেই, তাই ওরা হয়তো ভালোই আছে। তাজউদ্দীন রাইফেল আর পিস্তল হাতে করে চলে গেছেন কোনো অন্ধকার অনির্দিষ্ট পথে, হয়তো আলোকিত ভোর আনবেন বলে। কিন্তু এই বাড়িতে থাকা কি নিরাপদ হবে? তাজউদ্দীনের খোঁজে মিলিটারিরা কি আবার আসবে না? তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের জিম্মি করে রাখবে না, যাতে পাখি। স্বেচ্ছায় এসে ধরা দেয়! না, এই বাড়িতে আর এক মুহূর্ত নয়। লিলি বিছানা। ছাড়লেন। ভাঙা দরজা, ধ্বংসচূর্ণ, কাঁচ, কাঠ, সিমেন্টের জঞ্জাল পেরিয়ে সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেন তিনি। বাইরে মিলিটারির গাড়ি চলাচল করছে।
আবারও দূরে গর্জন শোনা গেল। কোথাও কামানের তোপ দাগা হচ্ছে। এই বাড়ি ছেড়ে পালাতেই হবে। লিলি ভাবলেন।
তিনি নিচতলার দরজা খুলে পেছনের বাগানে গেলেন। মাধবীলতার ঝাড় থেকে আসা একটা বুনো গন্ধ বারুদের গন্ধকে পরাজিত করে তার নাকে এসে লাগল। তিনি বাড়ির সীমানাপ্রাচীরের এপাশ-এপাশ নিরীক্ষণ করতে লাগলেন। বাসার দক্ষিণ দিকে একতলা বাড়ি। গাছগাছড়ায় ঢাকা। বাড়িওয়ালা থাকেন না বাড়িতে। থাকেন এক ব্যবসায়ী ভাড়াটে। মার্চের শুরু থেকেই তিনি পরিবার-পরিজন নিয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন গ্রামে। রেখে গেছেন এক বয়স্কা মহিলাকে, বাড়িটা দেখভাল করার জন্য। বাড়িতে কিছু হাঁস-মুরগি আছে, গাছগাছালি আছে, সেসব দেখারও তো লোক লাগে। সেই মহিলাকে দেখা গেল সকালবেলা। ঘরের বাইরে এসে হাঁস-মুরগির খোয়াড়ের কপাট খুলে দিলেন। একটা লাল রঙের মোরগ দৌড়ে বেরিয়ে এসে গলা বাড়িয়ে মাথা উঁচু করে ডেকে উঠল কুকুরুকু। মুরগিগুলো শুরু করে দিল ছোটাছুটি।
লিলি বললেন, এই শোনেন, একটা টুল আপনাদের দেয়ালের ওই পারে রাখেন তো। আমি আপনাদের বাসায় আসব। বাচ্চা দুইটাকে নিয়ে আসব।
মা গো মা, বাড়িত কেউ নাই, আমি তো বাড়ির ভিতরে থাহি না, আমি ঘরের বাহিরে থাহি। বলে এক দৌড়ে তিনি অদৃশ্য হয়ে গেলেন।
লিলি প্রমাদ গুনলেন। বাস্তবতা খুব নিষ্ঠুর। অবশ্য মহিলাকে দোষও দেওয়া যাবে না। তিনি নিজেই পরের বাড়িতে থাকেন। তা-ও বাহির বাটিতে। তিনি কী করে বাইরের মানুষকে আশ্রয় দিতে পারবেন? পরাশ্রিতরা কখনো আরেকজনকে আশ্রয় দিতে পারে না। দিতে চায়ও না।
কিছুক্ষণের জন্য হয়তো একটু আনমনা ছিলেন লিলি। উত্তর দিকের বাসায় থাকেন একজন বিদেশি কূটনীতিক। যুগোস্লাভিয়ার প্রতিনিধি। এ মুহূর্তে তিনি একাই আছেন। স্ত্রী-সন্তানদের মাসের শুরুতেই পাঠিয়ে দিয়েছেন তাঁর স্বদেশে। সেই ভদ্রলোককে দেখা গেল একটা বাদামি রঙের স্লিপিং গাউন পরে বারান্দায় হাঁটাহাঁটি করছেন। লিলির সঙ্গে চোখাচোখি হতেই ভদ্রলোককে দেখা গেল উত্তেজিত। গত রাতের গোলাগুলির পর তিনি হয়তো আশা করেননি যে পাশের বাড়ির কর্তী বেঁচে থাকবেন। তিনি এগিয়ে এলেন। ইশারায় জানতে চাইলেন, ডু ইউ নিড হেল্প। ডু ইউ নিড শেল্টার। ইউ ক্যান কাম হিয়ার।