হোয়ার ইজ তাজউদ্দীন?
আই হ্যাভ নো আইডিয়া!
তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়?
মুঝে নেহি পাতা।
আটাত্তর বছর বয়সী ভদ্রলোক সৈয়দ সেরাজুল হক বুক বরাবর ধরে রাখা স্টেনগানের নলের দিকে একবার তাকিয়ে সৈন্যদের মুখের দিকে তাকালেন। উর্দু-ইংরেজি মিলিয়ে জবাব দিতে লাগলেন।
সৈন্যরা তাকে হুকুম দিল শুয়ে পড়বার। তিনি ভাবলেন, এই শোয়াই শেষ শোয়া। তারা গুলি করবে এরপর। তিনি জোরে জোরে কলেমা পড়তে পড়তে বিছানায় শুয়ে পড়লেন। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ…
সৈন্যরা বাড়ি সার্চ করে পেল তাজউদ্দীনের ভাগনে হাসান, ভাতিজা তফাজ্জল, বাড়ির কেয়ারটেকার বারেক মিয়াকে। তাদের বন্দুকের বাঁট দিয়ে মারতে মারতে এক জায়গায় করা হলো।
বুটের শব্দে বাড়ি কাঁপিয়ে তারা সিঁড়ি বেয়ে উঠতে লাগল দোতলায়।
.
আর্মিরা ওপরে উঠছে।
লিলি আর আতিয়া ঠিক করেছেন, তারা পরিচয় দেবেন তারা বিহারি। এই বাড়িতে ভাড়া থাকেন। দুজনের পরনেই সালোয়ার-কামিজ। লিলির। কোলে এক বছর বয়সী শিশুপুত্র সোহেল।
মিলিটারি গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে উঠে গেল দোতলায়।
বাগমার বৈঠকখানায়। চারদিকে গুলির শব্দ। পুরো বাড়িতে আলো আর আলো। যেন আকাশের সব বজ্র একই সঙ্গে নেমে এসেছে এই বাড়িতে। তিনি টের পাচ্ছেন, বাড়ির চারদিকে মিলিটারি। সাতমসজিদ সড়কের পাশে খেলার মাঠের দিক থেকে শত শত সৈন্য তাদের আগ্নেয়াস্ত্রগুলোর নল ধানমন্ডি ১৫ নম্বরের এই বাড়ির দিকে তাক করে রেখেছে।
তিনি টের পাচ্ছেন আর্মিরা দোতলায় উঠেছে। বুটের শব্দ হচ্ছে খটখট।
দরজা খুলতে হলো না। গুলি করে দরজা ভেঙে একদল সৈন্য অস্ত্র উঁচিয়ে ঢুকে পড়ল দোতলার ঘরের ভেতরে। গুলিতে ঝাঁঝরা হয়ে গেল দেয়াল।
তারা সঙিন উঁচিয়ে উর্দুতে বলল, তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়? বাগমার উর্দু জানতেন। উর্দু জানেন লিলি আর আতিয়াও।
বাগমার জবাব দিলেন, উপর সব কেরায়াদার রেহতে হ্যায়…ওপরে সব ভাড়াটে। উয়ো গ্রাউন্ডফ্লোর মে হ্যায়…উনি নিচের তলায়।
সঙ্গে সঙ্গে একরাশ গুলি ছাদের পলেস্তারা খসিয়ে ফেলল। শব্দ আর আলোয় বাগমারের দৃষ্টি-শ্রুতি বিদীর্ণ হওয়ার জোগাড়।
ইয়ে বাতাও। তাজউদ্দীন কিধার হ্যায়?
তিনি সাহস হারালেন না, বললেন, আমরা ভাড়াটে। নিচের বাড়িওয়ালা কোথায়, আমরা জানব কী করে?
বাগমার আর লিলুকে বারান্দায় নেওয়া হলো। তাঁদের ঘিরে রইল গোটা দশ-বারো সৈন্য।
এবার সৈন্যরা গেল বেডরুমে। দরজা ধাক্কা দিতে লাগল ভয়ংকরভাবে। চিৎকার করে বলতে লাগল, দরওয়াজা খোল দো। নেহি তো গোলিছে উড়া দেঙ্গে।
আতিয়া পাল্টা চিৎকার করে উঠলেন, কৌন হ্যায়?
ফৌজি।
আতিয়া দরজা খুললেন, মালুম হ্যায় কিতনি রাত হুই? ইতনি রাত গ্যায়ে ইধার কিউ আয়ে?
সৈন্যরা দ্বিধাগ্রস্ত। এ তো দেখা যাচ্ছে উর্দুওয়ালা ফ্যামিলি। তারা বলল, হামলোগ কওমকি দুশমন তাজউদ্দীনকে তালাশ মে হ্যায়। কেয়া ও ইধার হ্যায় জি?
আতিয়া বিরক্তির অভিনয় করলেন। ঠোঁট উল্টে বললেন, হামলোগ কেরায়াদার হ্যায়। তাজউদ্দীন এতনে রাত মে এধার কিউ আয়েগা? ঠিক হ্যায়, আপ আন্দর আইয়ে আওর খুদ দেখ লিজিয়ে। এতনে রাত গ্যায়ে আপকা ইয়ে কাম গলত হ্যায়।
লিলির মনে ভয়, নিচের দেয়ালে তাঁদের ফটো ফ্রেমে বাঁধাই করা আছে, তাকে না মিলিটারিরা চিনে ফেলে। সোহেলকে মুখের কাছে ধরে মুখটা ঢেকে রেখে তিনি আতিয়ার উদ্দেশে বললেন, আরে জি তুমহে তো প্যাহেলে হি মানা কিয়েথে ইয়ে সাব পলিটিশিয়ানকে ঘর কেরায়া নেহি লেনা, আখের এহি থা নাসিবমে…তোমাকে আগেই বারবার করে মানা করেছিলাম, রাজনীতি করা লোকের বাড়ি ভাড়া নিয়ো না। এখন বুঝলে তো। আমাদের কপালে এই দুর্ভোগ ছিল। কালকেই টিকিট কেটে করাচি চলে যাব। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন…।
হামসে গালতি হো গ্যায়া। আপলোগ ইতমিনান সে রাহিয়ে, মুঝে অওর কুছ। নেহি কারনা। বলে সৈন্যরা বেডরুমে ঢুকে বিছানার নিচ, আলমারি, বাথরুম সব তালাশ করল। বারান্দায় তন্ন তন্ন করে খুঁজল তাজউদ্দীনকে পাওয়া যায় কি না।
পাওয়া গেল না। তারা বেরোনোর সময় বলল, ব্যাহেন, আপকো তকলিফ দিয়া। হামলোগকো মাফ কর দিজিয়ে। মিমির ঘুম ভেঙে গেছে। সে উঠে বসল। আতিয়া তাকে আবার শুইয়ে দিয়ে বললেন, সো যাও মেরা বাচ্চা, ঘাবড়ানেকা কোই বাত নেহি।
আর্মিরা এবার আরেকটা বেডরুমের দরজা ধাক্কাতে লাগল। আতিয়াকে বলল, ব্যাহেন, এই রুমে কারা আছে?
আতিয়া বললেন, মেহমান হ্যায় জি। নয়া শাদিশুদা মেহমান। নববিবাহিত মেহমান। আতিয়া ডাকলেন, শামীম, দরওয়াজা খোল দো।
শামীম বানু দরজা খুললেন। শামীমও ভালো উর্দু জানেন। উর্দুতে জানালেন, তাঁরা মেহমান। বিয়ের পর শখ করে ঢাকা বেড়াতে এসেছেন।
বুটের শব্দ তুলে সঙিন উঁচিয়ে ঘরের ভেতরে ঢুকে সৈন্যরা প্রতিটি ইঞ্চি তল্লাশি করে দেখল কোথাও তাজউদ্দীনের দেখা মেলে কি না।
লিলুকে আর আজিজ বাগমারকে এক জায়গায় রাখা হয়েছে। তাদের নিচে নামানো হচ্ছে বন্দুকের গুঁতো মেরে মেরে।
আতিয়া বললেন, বাচ্চেকো কিউ লে যা রহে হো?
বাগমার আর লিলুকে আনা হলো বৈঠকখানায়। দরজার জায়গাটা একটা বিশাল গহ্বর। সিমেন্ট, কাঠ, ইটের টুকরাটাকরা ধ্বংসস্তূপটাকে ভয়াবহ দেখাচ্ছে।