রক্তে আঁকা ভোর
০০১. আমার এই দেশেতে জন্ম
রক্তে আঁকা ভোর – আনিসুল হক
প্রথম প্রকাশ : ভাদ্র ১৪২৮, সেপ্টেম্বর ২০২১
উৎসর্গ
মুক্তিসংগ্রামে আত্মদানকারী ত্রিশ লাখ
শহীদের পুণ্যস্মৃতির উদ্দেশে
.
জরুরি প্রসঙ্গ
যারা ভোর এনেছিল, উষার দুয়ারে, আলো-আঁধারের যাত্রী, এই পথে আলো জ্বেলে, এখানে থেমো না–এই পাঁচটি বইয়ের পর এই বই, রক্তে আঁকা ভোর। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাত থেকে ১৯৭২ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সময়পর্ব এই ডকু-ফিকশনের পটভূমি।
এই বই রচনার জন্য বিভিন্ন গ্রন্থ, সংবাদপত্র, প্রামাণ্যচিত্র থেকে ব্যাপক সাহায্য নেওয়া হয়েছে। কোথাও কোথাও কোনো কোনো বই থেকে প্রায় হুবহু উদ্ধৃতি দেওয়া হয়েছে। ফলে এই গ্রন্থকারের একটা কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে সংকলকের, সংগ্রাহকের বা সম্পাদকের। কোন অংশ কোন বই থেকে নেওয়া হয়েছে, তার সূত্র বা উৎস নির্দেশ করতে গেলে টীকা-টিপ্পনী, তারকাচিহ্ন আর সংখ্যায় বইটি কণ্টকিত দেখাত, কিংবা সমৃদ্ধ হতো। কিন্তু তাতে উপাখ্যান হিসেবে বইটি পাঠ করাটা হয়ে পড়ত কঠিন। তাতে সত্যের দাবির প্রতি সম্মান দেখানো যেত, কিন্তু হৃদয়ের দাবি হতো উপেক্ষিত। পরিস্থিতি বোঝাতে একটা উদাহরণ দিই। আনিসুজ্জামান স্যার এই বইয়ের একটি চরিত্র। তাঁর মনের অনেক কথা, অনেক সংলাপ লিখতে সাহায্য নেওয়া হয়েছে তাঁর লেখা আমার একাত্তর বইয়ের।
১৯৭১ সাল এত বড় একটা ব্যাপার যে লক্ষ পৃষ্ঠা লিখলেও এর পরিপূর্ণ অবয়বের একটা রেখাচিত্রও সম্পূর্ণভাবে দাঁড় করানো যাবে না। সাড়ে সাত কোটি মানুষ যদি সাড়ে সাত কোটি গ্রন্থ রচনা করেন, তাহলেও বহু কথা।–বলাই থেকে যাবে। তারপরও বলব, নতুন প্রজন্মের সদস্যরা যদি রক্তে আঁকা ভোর পড়েন, তাহলে তারা আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপুল মহাসমুদ্রের বিশালতা সম্পর্কে একটা ধারণা লাভ করতে পারবেন। স্বাধীনতাসংগ্রামের একাত্তর পর্বের বিভিন্ন টুকরা-টাকরা অংশকে একত্র করার চেষ্টা করা হয়েছে এখানে। সবটা জোড়া দিলে একটা ছবি হয়তো দাঁড়িয়ে যায়।
আবারও বলছি, বইটি অন্য অনেক বই, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সংবাদ, প্রামাণ্যচিত্র থেকে সংগ্রহ করা ও বর্জন করা অসংখ্য টুকরো ছবির একটা সংযুক্তি। একজন সৃজনশীল লেখকের দৃষ্টিভঙ্গিতে তুলে ধরা ইতিহাসের একটা পর্ব, যার প্রধান উপাদান মানুষ–ছোট-বড় অসংখ্য মানুষ, দেশি-বিদেশি নানা কুশীলব।
এই গ্রন্থ পাঠ করতে হবে উপন্যাস হিসেবে, ইতিহাস হিসেবে নয়। এই প্রয়াসের সার্থকতা-ব্যর্থতা নিরূপণের ভার ভবিষ্যতের হাতে তোলা রইল।
সবাইকে ধন্যবাদ।
আনিসুল হক
ঢাকা, আগস্ট ২০২১
১
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি–ডি এল রায়ের গানের চরণ কেন মনে পড়ছে মুজিবের! তিনি কি মৃত্যুর গন্ধ পাচ্ছেন! মৃত্যুর গন্ধ, নাকি ভয়! ভয়ডর জিনিসটা তো টুঙ্গিপাড়ার বাইগার-মধুমতীতীরের মানুষটার দিলের মধ্যে আল্লাহ তাআলা দেননি। মৃত্যুর মতো সত্য পৃথিবীতে আর কিছুই নেই। জন্ম অনিশ্চিত ব্যাপার, কিন্তু একবার জন্ম নিলে একটা পরিণতিই তারপর একেবারে নিশ্চিত, অনিবার্য, অপরিহার্য-তার নাম মৃত্যু। মৃত্যু আসবেই। মৃত্যুকে বরণ করতে পারতে হবে হাসিমুখে! তবে মৃত্যুও কাম্য, সুন্দর, কাঙ্ক্ষিত, বরণীয় হয়ে উঠতে পারে, তা যদি বড় কোনো উদ্দেশ্যের জন্য, লক্ষ্যের জন্য হয়। আব্বার ভাষায় সিনসিয়ার এবং অনেস্ট পারপাজের জন্য হয়। তার জীবনে আর কোনো আফসোস নেই। কোনো খেদ নেই। ১৯৪৭ থেকে তাঁর জীবনের একটাই লক্ষ্য–বাংলার স্বাধীনতা। সেই লক্ষ্য পূরণ এখন অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে। তাকে হত্যা করা হবে কি হবে না, এটা তিনি জানেন না। দুটি ঘটনা ঘটতে পারে। তাকে হত্যা করা হবে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন। অথবা তাকে হত্যা করা হবে না, তাহলেও দেশ স্বাধীন। এই কথা গত ১৮টা ঘণ্টা ধরে তার বারবার মনে হয়েছে। কথাটা আজ সন্ধ্যার পর রেনুও বলেছেন, তিনিও উচ্চারণ করছেন।
দেশ স্বাধীন–কথাটা মনে হওয়ামাত্রই তাঁর মুখ একটা প্রশান্ত হাসিতে ভরে ওঠে। আজ সৃষ্টিসুখের উল্লাসে, মোর চোখ হাসে, মোর মুখ হাসে, মোর টগবগিয়ে খুন হাসে। এই সৃষ্টি স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি। এই সৃষ্টি একটা নতুন দেশের সৃষ্টি। আজ সন্ধ্যার পর যখন তিনি নিশ্চিত হলেন, মিলিটারি আক্রমণ করতে আসছে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পালিয়ে যাচ্ছেন, তখন থেকেই তিনি আপনমনে, পাগলের প্রায় হাসছিলেন। আই হ্যাভ গিভেন ইউ ফ্রিডম, নাউ গো, অ্যান্ড প্রিজারভ ইট। তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে এরা, কে জানে! ফায়ারিং স্কোয়াডে নেওয়া হতে পারে, ফাঁসিতে ঝোলানো হতে পারে। মৃত্যু যদি আসেই, হাসিমুখে বীরের মতোই বরণ করে নেবেন তিনি, কারণ তাঁর জীবনের বিনিময়ে অর্জিত হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। তবে তিনি চান, তার মৃত্যু বাংলার মাটিতেই হোক। বাংলার মাটিতেই হোক তার শেষ আশ্রয়। বাংলা মায়ের কোলেই যেন তিনি, শেখ মুজিবুর রহমান, অনন্তের ঘুম। ঘুমাতে পারেন। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্রনেতারা তাকে অভিধা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু, মানুষ তাকে এই নামে ডাকে, পত্রপত্রিকায় তাঁর নামের আগে বঙ্গবন্ধু লেখা হয়, মার্চের শুরু থেকেই ছাত্ররা তাঁকে ডাকতে শুরু করেছে জাতির পিতা বলে; তাঁর আব্বা এখনো তাকে ডাকেন খোকা নামে, মা-ও তাই; রেনুর কাছে তিনি হাছুর আব্বা, ছেলেমেয়েদের কাছে আব্বা; তাজউদ্দীন থেকে শুরু করে তরুণতর ছাত্রনেতা–রাজ্জাক, সিরাজ, তোফায়েল, শাহ মোয়াজ্জেমদের কাছে মুজিব ভাই, বহু মানুষের কাছে শেখ সাহেব। কিন্তু নিজের কাছে কী তিনি?