তিনি এঁকেছেন ৪৭-এর আগের যে পৃথিবী, সেই পৃথিবীতে হিন্দু মুসলমান দুটি আলাদা সত্তা যেন ছিলই না। হিন্দু মুসলমানের হৃদয়ের অভিন্নতাই ছিল সেই অপূর্ব শৈশবের যাদু। আর তা ক্রমশ ভেঙে যেতে থাকে পাকিস্তানের জন্ম হতে থাকায়। সেই ইতিহাস আমাদের জানা। অনেক রাজনৈতিক কচকচি আছে। সেই কুৎসিত রাজনীতির ভিতরে প্রবেশ করেননি লেখক। তিনি একটি সাধারণ পরিবার সাধারণ মানুষের কথা বলেছেন। অতি সাধারণ হয়েছে সেই পোকা, আব্দুল খালেক। গ্রাম ছেড়ে পরিবারটি যখন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে, পাকিস্তানের দিকে রওনা হচ্ছে, তখন মণি ভাইজান ট্রাকে না উঠে দৌড় লাগায় পোকাকে নিয়ে। কোথায় গেল তারা, ছবিদের বাড়ি। ছবি পোকার দিদি রানিবুবুর বন্ধু। হা হা করে ওঠে বুক। হায় রে কে জানত মণি ভাইজান ভালবাসত যে মেয়েটিকে, তাকে এই জীবনের মতো, সমস্ত জীবনের মতো ছেড়ে চলে যাচ্ছে। ছবি তুই আমারে কিছু দে? কী দেবে ছবি মনিকে। মাথার লাল ফিতে খুলে দিল, চুলের কাঁটা, ক্লিপ—তাই নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে মনি ভাইজান পোকাকে নিয়ে ফিরল পাকিস্তানের উদ্দেশে যাত্রা করা সেই ট্রাকের কাছে। মনি ভাইজান তার দুঃখকে ভোলেনি। সেই যে পদ্মার ভিতরে অন্ধকারে দূর অনিশ্চিত—পাকিস্তান যাত্রা, তারপাশা, ভাগ্যকুল, গোয়ালন্দ—ঘাটে ঘাটে দাঁড়ানো, বিদায় ঘাটে ঘাটে দাঁড়ানো, মণির হাতে লাল ফিতে, চুলের কাঁটা, ক্লিপ—লুকোন কান্নায় মুচড়ে যাচ্ছে সে। মণি পরে কটি ঘুমের বড়ি খেয়ে মরেছিল। টিপু আছে সৌদি আরবে। রানি বুবুর সুখের সংসার। খালেক মানে সেই পোকা, সত্যিকারের পোকার মতো বেঁচে আছে। হিন্দুস্তান পাকিস্তান, সেই দেশভাগ নিরূপায় সাধারণ মানুষের জীবনকে যে ভাবে নষ্ট করেছিল, এই উপন্যাস সেই কথা উচ্চারণ করেছে। একেবারে সাধারণ মানুষের কথা, না কোনো রাজনৈতিক কার্যকারণ সূত্র, তত্ব এখানে নেই, আছে শুধু সাধারণ মানুষের জীবনের বেদনার কথা, যে কথার খোঁজ রাখেননি আমাদের দেশ নায়করা। এই উপন্যাসে আছে সরল জীবন জটিল হয়ে ওঠার বৃত্তান্ত। আছে ক্রমে সঞ্চারিত ভয়ের বৃত্তান্ত। হ্যাঁ, মাহমুদুল হকের উপন্যাস পড়ে আমার মনে জেগে উঠছে রাজনৈতিক সেই সিদ্ধান্তের প্রতি চরম ঘৃণা। আসলে সাধারণ মানুষের কথা কেউ ভাবেন না কখনো। এখনো না। আমাদের এত বছরের স্বাধীনতা হলো উচ্ছেদের সত্তর বছর। ভিটে হারানোর সত্তর বছর।
এই উপন্যাসের সময় সেই ১৯৪৭-এর শৈশব আর হয়তো গত শতাব্দীর ৮০-র দশক। স্বাধীনতা এসেছে, বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে, কিন্তু সমাজের অসুখটা তো যায়নি। নরহরি ডাক্তারের হতাশা থেকে তা ধরা যায়। মালাউন—বলে তার প্রতি ঘৃণা প্রকাশ করে বাজারে তারই প্রতিবেশী। আব্দুল খালেকের কলেজ উঠেই যাবে। তার মনের ভিতরে সেই শৈশব পাহাড় হয়ে থাকে। সেই যে মাধুরী-মাধু নামের বিধবা বউটির হাতে অসুস্থ হয়ে পড়া স্যাকরা নগেন নিয়েছিল আশ্রয়, সামান্য সেই স্যাকরার প্রেম হয়েছিল ঘুটে কুড়ুনি কাঠ কুড়ুনি মাধুর সঙ্গে। স্যাকরার ছিল ক্ষয় রোগ। স্যাকরা ভালবেসেছিল তাকে। স্যাকরাকেও ভালবেসেছিল সে। কী অপূর্ব সেই প্রেম দেখেছিল বালক। স্যাকরার অন্তিম অবস্থা আর তাকে বাঁচিয়ে তোলার অদম্য ইচ্ছা, মণি ভাইজানের হাত ধরে সে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ‘কিছু করতে পারলাম না, ইচ্ছে ছিল! আমি কি কিছু চেয়েছি! বুক ফেটে যায়, ও বাবা গো।’ মণি ভাইজানের ছিল নরম প্রাণ। সে বাড়ি থেকে পাঁচ টাকা চুরি করে এনে মাধুরীর হাতে দিয়েছিল নগেন স্যাকরাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার জন্য।
সেই মাধু, মাধুরীকে ভোলেনি পোকা—আব্দুল খালেক। সেই প্রেমের কথাও ভোলেনি। সে আর রেখা বেরিয়েছিল একটি নৌকো নিয়ে। হয় তো যে জীবন ফড়িঙের দোয়েলের তার সাথে দেখা হবে, সেই আশায়। তাদের প্রেম যেন ফুরিয়ে যাচ্ছিল। শৈশবে সব হারানোর বেদনা তাকে অধিকার করে ফেলেছিল। “সেসব কত কথা। ইচ্ছে করলেও এখন আর মনে পড়ে না। কতো কথা, কতো চার ভাঁজ করা ছবি, তেশিরা কাচ, লালকুঁচ, কতো সকাল–দুপুর-বিকেল বোকার মতো হারিয়ে ফেলেছে পোকা! কখনো মনে হয়নি, একদিন সব কিছুর আবার খোঁজ পড়বে নতুন করে। বড় অবহেলা ছিল পোকার, বড় অবহেলা। অযত্ন আর হেলাফেলায় কতো কিছুই যে সে হারিয়ে ফেলেছে!…।” কী অপূর্ব এক নদীপথে স্বামী স্ত্রীর যাত্রায় এই উপন্যাস তার অন্তিমে পৌঁছয়। বিল, গাঙ, সেই পদ্মার ঘোলা জলের কাছে পৌঁছন। এক জায়গায় নৌকো ভিড়িয়ে তারা বনের ভিতরে নেমে যায়…। মিলিত হয় ভালবাসায়। গলায় হাত দিয়েও হাত সরিয়ে নিয়ে এসেছিল পোকা। তারপর নদীতে সাঁতের কেটে দুজনে ফিরে আসে নৌকোয়। মৃত মণি ভাইজানের কথা শুনতে চায় রেখা—পোকার প্রেমের মাধুরী। রেখার প্রতি আব্দুল খালেকের প্রেম কতটা নিবিড়, সেই নিরূপায় প্রেমিক-প্রেমিকা, স্যাকরা আর মাধুর যেমন ছিল, তেমনি হয়ে ওঠে অতি অন্তরঙ্গ মুহূর্তে। পোকা, আব্দুল খালেক ডাকে তাকে মাধুরী নামে। ফিরে আসে সেই নিবার্সনের শৈশব। ভাগ্যকুল, তোকে আমি মারব, তারপাশা, তোকে আমি মারব, নদী, তোকে আমি মারব। মারবে, সেই ভাগ্যকুল, তারপাশাই তো তাকে এই জীবনব্যপী নিবার্সনে এনেছে যেন। এই উপন্যাস অনন্ত এক অশ্রুপাতের। যে অশ্রুপাত আমি আমার ছোটবেলা থেকে দেখেছি আমার মায়ের ভিতরে। যে অশ্রুপাত থামেনি। থামবে বলে মনে হয় না। জন্ম-জন্মান্তরে প্রবাহিত হয়ে যাবে। যাবেই।