আসছি ফিরে। আবার নদীঘাট। কাশেমের ঘাট। পিছনে ফিরে তাকালাম। পাট ক্ষেতের আড়ালে চলে গেছে গ্রাম আর মানুষ। হয় তো আর কখনোই আসা হবে না এখানে। কিন্তু মনে থাকবে সেই হাসিমুখখানি। তাঁর হাতে মিষ্টান্নের প্যাকেট দিয়েছিলাম আমি। তিনি নিলেন। কথা বলতে পারেন না মনে হয়। দেহ কাঁপছে। আমার দেশের নাগরিক হলেন তিনি আজ থেকে। তাঁর মুখে হাসি ফোটানোই এখন প্রশাসনের বড় কাজ। পতাকার মর্যাদা তাতেই রক্ষিত হয়। স্বাধীনতা হোক আকাশের মতো। রৌদ্র ছায়া তুমি স্বাধীনতা। মুছে দিও সব অপমান, সমস্ত লাঞ্ছনা।
স্বাধীনতা তুমি,
খোকার গায়ের রঙিন কোর্তা,
খুকির অমন তুলতুলে গালে রৌদ্রের খেলা।
স্বাধীনতা তুমি
বাগানের ঘর, কোকিলের গান
বয়েসি বটের ঝিলমিল পাতা,
যেমন ইচ্ছে লেখার আমার কবিতার খাতা।
-শামসুর রহমান
কালো বরফ, জাতির জীবনের কালো দিনের কথা
মাহমুদুল হক ততো পরিচিত নন এদেশে। তিনি বাংলাদেশের লেখক। এখন বেঁচে নেই। তিনিও হাসান আজিজুল হকের মতো এপারের মানুষ, পারটিশনের পর তাঁদের পরিবার তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। এই বই সেই দেশভাগের বিষ-বেদনা ধারণ করে আছে নীলকন্ঠের মতো।
আসলে আমরা চলে এসেছিলাম, ওঁরা চলে গিয়েছিলেন। আমরা মানে আমার বাবা কাকারা, আমার দাদা, এঁরা ছেড়ে এসেছিলেন এজাহার শানা, মোজাহার শানা, কুলছুম, ময়রম…কাল ভৈরব, চণ্ডী মণ্ডপ, বাগান পুকুর, প্রতিবেশীজন। ওঁরা ছেড়ে গিয়েছিলেন বারাসত, হাতিপুকুর, শেঠপুকুর, কাজীপাড়া, ছবিদি, টুকু, কেনারামকাকা, নির্মলকাকা…। জাতির ভবিতব্য যা ছিল তাই ঘটেছিল। আর সেই মিলিত শোক এত বছরেও কাটেনি। মিলিয়ে যায়নি। তাই এখনো দেশ বিভাগ নিয়ে কথা হয়। লেখক তাঁর শোকের কথা রেখে যান তাঁর রচনায়। আমার মা ২০০৪-এ চলে গেছেন, ১৯৪৭ থেকে এতটি বছর দুঃখ নিয়ে বেঁচেছেন। তিনি সেই কপোতাক্ষ, বড়দলের স্টিমারঘাটা, ধুরোল সাতক্ষীরে আর বাঁকা-ভবানীপুর গ্রামের কথা বলেই গেছেন। তাঁর কাছে শুনে শুনে আমি চিনেছিলাম আমাদের ফেলে আসা মাটি আর দেশ। মা রাধারানির বেদনাকেই উত্তরাধিকার সূত্রে ধারণ করেছি আমি। সদ্য ঘুরে এসেছি মায়ের বাপের বাড়ি, আমার মাতৃকুলের দেশ, সেই গ্রাম, মজে যাওয়া কপোতাক্ষ নদ, টের পেয়েছি কীভাবে আমরা ধারণ করি সমস্ত বেদনার ভার। দেশ ভাগের সময়কাল যত দীর্ঘ হচ্ছে, দেশ ভাগের কথা ততো উঠে আসছে এই কালের লেখকদের লেখায়।
কালো বরফ প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯২ সালে। তখন পূর্ব পাকিস্তান নেই। যে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিল তারা, সেই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্ম হয়েছে। ওপারের বাঙালি নিজের দেশ পেয়েছে কুড়ি বছরের উপর, কিন্তু তখনো বুঝি যায়নি পুরাতন শোক, তাই তাঁকে সেই শোকের কথা লিখে যেতে হয় অত বছর পরে। ‘কালো বরফ’ হল সেই শোকগাথা যা ক্রমাগত পাঠই হয়ে যাবে। আমি বছর দশ আগে প্রথম পড়ি, আবার পড়ি এখন। আমি সেই প্রথম পাঠকে ভুলিনি, দ্বিতীয় এই পাঠও আমার কাছে নতুন হয়ে এসেছে। আমি এখনো শুনতে পাচ্ছি রাত গভীরে ঘাটের পর ঘাট পার হয়ে গেছে স্টিমার, দেশ জুড়ে বিদায়ঘাট, তারপাশা, ভাগ্যকুল, ষাটনল, লৌহজং-তোদের আমি মারব, তারপাশা তোকে আমি মারব, ভাগ্যকুল তোকে আমি মারব, নদী তোকে আমি মারব…। আবার তো এও শুনেছি তারপাশা, ভাগ্যকুল, গোয়ালন্দ, ধুরোল, সাতক্ষীরে, কপোতাক্ষ, তোদের জন্য আমি কাঁদব। কাঁদব। সেই ক্রন্দনধ্বনি এখনো শোনা যায়। আমি ‘কালো বরফ’ পড়তে পড়তে আবার শুনতে পেয়েছি সেই কান্না। রাত দুপুরে আব্দুল খালেক কাঁদছে একা অন্ধকারে। তার বউ রেখা টের পেয়েও তাকে কাঁদতে দেয়। আসলে দেশভাগ তো নয়, মানুষের অন্তরটাকে ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দেওয়া। সেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন হৃদয় জোড়া লাগে না। লাগেনি এতবছরেও। ‘কালো বরফ’ সেই কাহিনি যেমন, তেমনই দুই নিরূপায় মানুষের কাহিনিও। আব্দুল খালেক ও রেখা। রেখার মা বাবা ছিল না, মামার বাড়ি লাথি-ঝেঁটা খেয়ে মানুষ। সে আব্দুল খালেকের সংসারে এসে শুধুই অভাবের সঙ্গে যুদ্ধ করে যাচ্ছে। স্বামী স্বাভাবিক নয়, রোজগেরে নয় তেমন। তার কলেজ অ্যাফিলিয়েশন পায়নি। কলেজ থাকবে না সেটি আলুর গুদাম হয়ে যাবে, তার ঠিক নেই। মন মরা হয়ে থাকে সব সময়। আব্দুল খালেক — পোকার কিছু একটা হয়েছে, কী হয়েছে তা রেখা জানে না। আন্দাজও করতে পারে না যে তার স্বামী ছেড়ে আসা শৈশব আর গ্রামের শোক ধারণ করে আছে এত বছর ধরে। সে এদিক থেকে ওদিকে যায়নি, কিন্তু সে ছিল নিরালম্ব এক মানবী। সেই ছোটবেলা থেকেই। সেই নিরালম্বতা তাকে ভীত করে। উদাসীন আর সতত অন্যমনস্ক স্বামীকে দেখে তার ভয় হয়, সে কি অন্য কোনো নারীর প্রেমে পড়েছে ? সে বাজার থেকে ডেকে আনে নরহরি ডাক্তারকে। ডাক্তারের চেম্বারে বসে সে সময় কাটায়, ডাক্তার জানতে পারে হয় তো। তার কাছে জিজ্ঞেস করে, কী হয়েছে তার স্বামীর, সে বুঝতে পারে না, সন্দেহ হয় তার…।
আসলে শিকড় তো অনেক গহীনে। সেখানে প্রবেশ করবে কী করে রেখা? সে ছিল নিরূপায় নিরালম্ব এক মানবী, খালেকও কি তাই নয়? খালেক-পোকার রক্তে যে শৈশব রয়েছে তাকে সে এড়াতে পারে না। তাকে সে ভোলেনি। টিপু ভাইজান, মনি ভাইজান, ছবিদি, ইস্কুল, পা ভাঙ্গা শালিক… কী অপূর্ব এক শৈশব এঁকেছেন মাহমুদুল হক। সেই শৈশবই খেয়েছে তার প্রাণমন। সেই ফেলে আসা গ্রাম, মানুষজন। ১৯৪৭-এর কথা তা। তখন বালকের বয়স আট হবে বড় জোর। ক্লাস টু। তার দাদা টিপু কলেজে ভর্তি হয়েছে। মনি ভাইজান ক্লাস নাইন হবে কি? সেই বালকের অমল শৈশবই এই উপন্যাসের আধার। এই উপন্যাসের প্রাণ। ছোট ছোট এমন অনুষঙ্গে ভরে আছে এই উপন্যাস যে পড়তে পড়তে বুক মুচড়ে যায়। দেখতে পাই আমার জন্মের আগের পৃথিবী। এই উপন্যাস তো আমাকে জাতিস্মর করে তোলে। দেখতে পাই সেই সময়কে। সেই যে বালক, পোকা যার ডাক নাম, মানে যে নামে তাকে ডাকত তার আব্বার বন্ধু, গ্রাম সম্পর্কে কাকা কেনারাম, যে কাকার হাত ধরে সে হাতি পুকুর চেনে, শেঠ পুকুর চেনে, সেই যে ছবিদি, পুঁটি নামের আলতা পায়ের মেয়েটি, যে অদ্ভুত সব কথা বলত, মাছের কথা, পাখির কথা, গাছের কথা বুঝতে পারত, গাছের গোড়ায় জল ঢেলে বলত, ‘গাছভাই গাছভাই, এই দ্যাখো আমি তোমার গোড়ায় এক ঘটি জল দিলাম, আমার যেন খুব ভাল বর হয়, নইলে কিন্তু খুব খারাপ হবে, একটা ডালপালাও তোমার আস্ত থাকবে না।’