অনেকদিন পরে এদিন পনু মিয়াকে দেখলাম। সঙ্গে জি রহমান। আগের চেয়ে গায়ের রং আরও উজ্জ্বল হয়েছে। স্বাস্থ্যে ভরপুর। সম্প্রতি আরেকটি বিয়েও করেছেন। আমাদের বাসায় এলেন। যে ঘরটিতে ঠাকুর্দা থাকতেন তার দরোজা লাথি মেরে খুলে ফেললেন। বাবাকে ঠাণ্ডা গলায় বললেন, এটা খালি করে দাও।
এ ঘরটি সাড়ে তিন বছর আগে তার দখলে ছিল। অফিস ছিল রাজাকার কমিটির। আজ আবার ঘরটি তাদের দখলে চলে গেল।
সুরুদ্দিন মাস্টার অনেকদির পক্ষাঘাতগ্রস্থ হয়ে বিছানায় পড়েছিলেন। তার চোখে আজ সুরমা টানা। পরনে আচকান। পায়ে মোকাসিন। মাথায় জিন্নাহ টুপি। জি রহমানের সঙ্গে বুক মেলালেন। তার অসুখ সেরে গেছে। তার বড়ো মেয়েটি শেখা আপা দীর্ঘদিন পরে অন্দরে ঢুকলেন নিরিবিলি ঘুমাতে। আর সে ঘর থেকে শুকনো মুখে কিছু খোঁচা খোঁচা দাড়ি, বাবরি চুলের যুবক বাইরে এসে দাঁড়াল। তারা এখন কি করবে বুঝতে পারছে না। পনু মিয়াকে দেখে বড়ো করে সালাম ঠুকল। পনু মিয়া তাদের মাথা থেকে লাল ফেট্টি খুলে দিলেন। পিঠ চাপড়ে বললেন, গুড জব। তোমরা অনেক করেছো।
ওরা সবাই ছিল ক্ষুধার্ত। বিনোদ শা’র রাম ছাগলটিকে প্রকাশ্য রাস্তায় জবাই করল। বিনোদ শা নদীর দিকে ছুটে গেলেন। তারপর শুরু হল রান্না। অনেকগুলো লোক সেদিনই অন্ধকার থেকে বাইরে বেরিয়ে এসেছে। আকাশের দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখছে, মাঝে মাঝে হেলিকপ্টার চক্কর দিচ্ছে। উড়ে যাচ্ছে দক্ষিণে। অই গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া।
অনেকদিন পরে এইসব লোকজনের চমৎকার একটি ভোজ হল। চারিদিকে পাকিস্তানী মশলা আর বাংলার ঝলসানো গোস্তের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে- একটি রাস্তা থেকে অনেকগুলো রাস্তায়। বাড়িঘরে। অফিস আর স্কুলে। পুলিশ ব্যারাকে। ধর্মশালায়। আদালতে। নদীতে। ধানক্ষেতে। গাছে গাছে। আকাশে। কবরে। মগজে।”
এই সব কথা অনেকটাই আবেগের। কিন্তু আমি তা সত্য জানি। সেই ১৫-ই আগস্ট আর তার পরের অনেকদিন ছিল চোখের জলের। তিনি শুধু বাংলাদেশের মানুষের চোখের জল মুছিয়ে দেননি,আমার মায়ের চোখের জলও মুছিয়ে দিয়েছিলেন, আমার বাবার মনে এনেছিলেন আনন্দ। প্রণাম তাঁকে।
আমার লেখায় ক্রমাগত বাংলাদেশ এসে যায়। এসেই যায়। সাতক্ষীরে, ধুলিহর, কপোতাক্ষকে আমি আমার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দেব বলেছিলাম। ফিরিয়ে দিতে চাইছি সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি থেকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব আমার পিতৃপুরুষ। পিতৃপুরুষের তর্পণ হলো তাঁরই ডাকে, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম…। হ্যাঁ, জানি মানুষের সংগ্রাম ফুরোয় না। সংগ্রামের শেষ নেই। শেখ মুজিবরের জীবন থেকে সেই শিক্ষাই পেয়েছি আমরা।