কত মানুষ আর কত মানুষ! সেই মানুষের ভিতর আমিও ছিলাম। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাঁর অসামান্য বজ্রগম্ভীর কন্ঠে বলেছিলেন, “স্বাধীনতা পেয়েছি, বড় রক্তের বিনিময়ে পেয়েছি, এত রক্ত কোনো জাত কোনো দেশে কোনো দিন দেয় নাই, যা আমার বাংলাদেশের মানুষ দিয়েছে। আমার লোকেরা, বৃদ্ধ থেকে বালক পর্যন্ত সকলেই সংগ্রাম করেছে, সেই সংগ্রাম কামিয়াব হতে পারত না যদি ভারতের জনসাধারণ এগিয়ে না আসত… তিনি বলেছিলেন, “আমার দেবার মতো কিছু নাই, শুধু আমি এইটুকু দিতে পারি, নিঃস্ব আমি রিক্ত আমি দেবার কিছু নাই, আছে শুধু ভালোবাসা দিলাম শুধু তাই।”
তিনি বলেছিলেন, “আমরা ঘোষণা করেছি আমরা স্বাধীন, তুমি কোন জায়গার বাটপার হয়ে বললা, তুমি বলছ বাংলাদেশ তোমাদের অংশ, ভুলে যাও বন্ধু, সুখে থাকো বন্ধু, বাংলাদেশ স্বাধীন, বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র, বাংলাদেশ স্বাধীন থাকবে, তোমার ক্ষমতা নাই, বাংলার স্বাধীনতা হরণ করতে পার না…। আপনারা আমার সঙ্গে শ্লোগান দেন, জয় বাংলা, জয় বাংলা…। আমার মা রেডিওর ধারা বিবরণী শুনতে শুনতে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে গলা মিলিয়েছিলেন কতবার, যতবার তা বেজেছিল।
মনে পড়ে সেই ১৫-ই আগস্টের কথা আমরা শুনলাম সন্ধ্যায়। তখন আমাদের দেশে জরুরি অবস্থা জারি। বঙ্গবন্ধু নিহত হয়েছেন। তাঁকে হত্যা করেছে স্বাধীনতা বিরোধী একদল সামরিক কর্তা। শোকাহত হয়েছিলাম। মনে হয়েছিল আবার দূরে সরে গেল আমাদের কপোতাক্ষ নদ, সাতক্ষীরা, ধূলিহর, পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। আবার যোজন যোজন দূরে চলে গেল সাতক্ষীরে মহকুমার সামান্য এক গ্রাম ধূলিহর।
শেখ মুজিবর রহমান জন্মেছিলেন গোপালগঞ্জ জেলায়। ১৯২০ সালের ১৭-ই মার্চ। বছর সাত-আট আগে আন্তরজাল যখন আমার কাছে পৌঁছল এমন কয়েকজন বাংলাদেশের বন্ধু হলো, যাঁদের আদিবাড়ি ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমায়। হ্যাঁ, গোপালগঞ্জ এখন জেলা। অবিভক্ত ফরিদপুর অনেক সুসন্তানের জন্ম দিয়েছে জানি। লেখক নরেন্দ্রনাথ মিত্র, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, চলচ্চিত্রকার মৃণাল সেন সকলেই ফরিদপুরের সন্তান। পাহাড়ের মতো মানুষ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান জন্মেছিলেন ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ শহর থেকে ১৮ কিলোমিটার দূরে টুঙ্গিপাড়ায়। আমার বন্ধু কুলদা রায়, রুকসানা কাজল, কচি রেজার বাড়ি গোপালগঞ্জে। তাঁরা বললেন তাঁদের কারো বাসা গোপালগঞ্জ শহরের উদয়ণ রোডে, কারো বাড়ি কালিবাড়ি থিয়েটার রোডে। বঙ্গবন্ধুর পরিবারের শহরের বাসা কোর্ট মসজিদের পাশে। কুলদা রায় গোপাল গঞ্জের মানুষ, লেখেন ১৯৭৫ সালের ১৫-ই আগস্টের কথা এইভাবে…।
“একদিন ঠাকুরদা রওনা হলেন ঢাকায়। অনেক বয়েস হয়েছে। এটাই তার শেষ তীর্থ যাত্রা। ধূতি পাঞ্জাবী ধোপা বাড়ি থেকে ধুইয়ে আনা হল। সঙ্গে গেল বাউল। তার বাউলা ড্রেস। বলে, আমি আউলা মানুষ। নামাজও পড়ি। আবার গানও গাই। আমার তো কোনো জাত ফাত নেই। বিনোদ শাহ যেতে পারলেন না। দিন দুনিয়ায় তাঁর কেউ নেই। যাঁরা ছিল তাঁরা একাত্তুরে শহীদ। এখন কেবল একটি রামছাগল তার সঙ্গী। তিনি ঢাকায় গেলে রামছাগলকে কে দেখবে? চোখের জল ফেলতে ফেলতে বিনোদ শাহ বললেন, ‘শেখরে কৈয়েন ছোটোবাবু, তোমার জন্য বুকটান কৈরা হাঁটতে পারছি। তোমার মুখের দিকেই চাইয়া বাঁইচা আছি। তোমারে সালাম।’
আর গেলেন কাশেম কবিরাজ। কবিতা লেখেন। আর তসবী টেপেন। এক সময় নাটকও করতেন। জলিরপাড় থেকে উঠবেন টমাস তিমথি সরকার।
বাবার মন খুব খুশি। এবার আমাদের কপাল ফিরতে পারে। মা দুদিন পায়েস রান্না করে ঠাকুরের ভোগ দিলেন।
ঠাকুরদা ফিরলেন দিন চারেক পরে। খুব সুখি। বাবাকে বললেন, কিছু কি চাইতে গেছি নিকিরে! তিনিতো মানুষ নন। তিনি আমাগো চোখের জল মুছায় দিছেন। নিজের মাটিকে নিজের করে দিয়েছেন। নিজের ঘরকে নিজের করে দিয়েছেন। তার কাছে কি আর কিছু চাওয়ার থাকেরে পাগলা! তিনি বুকে টেনে নিয়েছেন। বলেছেন, কোনো ভয় নেই। আমি আছি। আমার প্রাণ ভরে গেছে।
এর কিছুদিন পরে ঠাকুরদা মারা গেলেন। তাঁর কোনো দুঃখ ছিল না। তিনি গেলেন পূর্ণতার লাবণ্য নিয়ে।
একদির ভোরবেলায় বাবা কাজে গেলেন না। বাবা পুরনো রেডিওটাকে চড় থাপ্পড় দিচ্ছেন। কড় কড় শব্দ করে একদম থেমে গেল।
বাবা ধাই ধাই করে ছুটে গেলেন হারুন চাচার বাড়িতে। হারুনচাচা রেডিও শুনছিলেন। চোখে জল। রেডিও বন্ধ করে দিলেন। বললেন, বাড়ি ফিরে যাও। দ্যাখো বাঁচতে পারো কিনা। বাংলাদেশে আবার দোজখ নেমে আসছে।
বাড়ি ফিরতে ফিরতে দেখলাম, আওয়ামী লীগের সভাপতি সাবু মিয়া আর ছোটকা দাস ধানি মাঠের মধ্যে নেমে যাচ্ছেন। কমরেড শওকত চৌধুরী তাদের পথ আগলে দাঁড়ালেন। বললেন, পালিয়ে যাচ্ছেন কেন? আসেন রুখে দাঁড়াই।
সাবু মিয়া ফ্যাস ফ্যাস করে জবাব দিলেন, সম্ভব নয়। অস্ত্রপাতি নাই। জমা দিয়া ফেলাইছি।
-জনগণকে নিয়ে নেমে পড়ি। অস্ত্রের কি দরকার?
-ওদের হাতে অনেক অস্ত্র, অনেক টাকা পয়সা আর।
এরপর কি বললেন বোঝা গেল না। ঘোড়া জামাল কমরেড শওকত চৌধুরীকে ধাক্কা মেরে ছুটে বেরিয়ে গেলেন অনেক দূরে। তার ঘোড়াটি হা করে তাকিয়ে রইল। তার পিঠে কোনো সওয়ার নেই। যে কেউই উঠে পড়তে পারে এখন।