তিনি আরম্ভেই বাংলার কথা বলেন। জাতির আত্মপরিচয়ের কথা বলেন। ৫২-র ২১শে ফেব্রুয়ারির পর এই ভাষণই যেন ১৬ বছর পরের বাংলা নামে দেশটির জন্মের সূচনা হয়ে দাঁড়ায়। বাঙালি, বাঙলাভাষা, বাঙালির জাতিসত্ত্বা প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন ছিল তাঁর রক্তের অন্তর্গত। সেই স্বপ্ন নিয়েই বাংলাদেশের জন্ম। স্বপ্ন একদিনে পূরণ হয় না। ক্রমাগত পূরণ করে যেতে হয়। বাংলাদেশে তা হচ্ছে কি হচ্ছে না জানি না, কিন্তু নবান্ন, ঘরে ঘরে পিঠেপুলির উৎসব, এক মাস একুশের বইমেলা, ১লা ফাল্গুন রঙের উৎসব, ১লা বৈশাখ নববর্ষ উদযাপন বাংলা মায়ের ছবির পিছনে যেন আলোক বলয় সৃষ্টি করে যাচ্ছে অবিরত। লৌকিক যে জীবনকে বাঁচিয়ে তোলার কাজটি বাংলাদেশে হচ্ছে নানাভাবে তা নিয়েই বাঙালি আর পাঁচটি জনগোষ্ঠী থেকে আলাদা ছিল। একটা জাতি তার ভাষা আর সংস্কৃতিকে যেভাবে রক্ষা করছে নানা প্রতিকূলতার ভিতরে তা দেখে আমার মনে হয় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শেষ হয়নি। মুক্তিযুদ্ধ চলছে। শেখ মুজিবর রহমান আছেন বাংলাদেশের হৃদয়ে। আলোয় বাতাসে। বাঙালি তার জাতি সত্ত্বা নিয়ে বিকশিত হচ্ছে। একটা ফুল ফুটছে আর ফুটছে। পাখি ডানা মেলছে আর মেলছে। এই ফুটে ওঠা আর মেলে দেওয়ার শেষ নেই। জাতি হিসেবে আমি এই বাঙালির একজন, আমার দেশ অন্য দেশ হলেও আমি আমার আত্মপরিচয় খুঁজে পেয়েছি সেই মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি থেকে। বঙ্গবন্ধুর কাছে তাই সব সময় প্রণত। মনে হয় নেতাজি সুভাষের অসমাপ্ত কাজ তিনিই সমাপ্ত করেছেন। আমাদের শহরে ১৯৭২-এর ফেব্রুয়ারিতে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান এসেছিলেন। দিনটি ৬-ই ফেব্রুয়ারি। সদ্য পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে তিনি যুদ্ধ বিধ্বস্ত নিজ দেশে ফিরেছিলেন। দেশ তখন স্বাধীন। ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডে সেই সভা হয়েছিল। জমায়েত লক্ষ লক্ষ এদেশের মানুষ। সমস্ত কলকাতা আর শহরতলী মাঠে গিয়ে হাজির হয়েছিল। কলকাতা সমস্বরে উচ্চারণ করেছিল, ‘জয় বাংলা’। আমিও গিয়েছিলাম। তাঁকে দেখতে পাইনি। কাতারে কাতারে মানুষ গেছে সেই মিটিং’এ। কী করে দেখব আমার স্বপ্নের নায়ককে। আবছা আবছা দেখছি সব। কিন্তু বারবার মনে হচ্ছে নেতাজি ফিরে এসেছেন শেখ মুজিব হয়ে। লাউড স্পিকারে তাঁর বজ্রগর্ভ কন্ঠস্বর শুনেছিলাম। ১৯৭১-এর ৭-ই মার্চের কথা শুনেছি, তাঁর জ্যেষ্ঠা কন্যা, বাংলাদেশের মাননীয়া প্রধানমন্ত্রী শ্রদ্ধেয়া শেখ হাসিনার লেখা পড়েছি দেশ পত্রিকায়, এই সেদিন, গেল ১৭-ই মার্চ, পড়ে মনে হয়েছিল, তিনি যেন আমাদের গড়ের মাঠের কথাই লিখেছেন, যে মিটিং’এ গিয়ে আমি শীতের বেলার আবছা কুয়াশার ভিতরে বুঝি দেখেছিলাম মস্ত এক পাহাড় দাঁড়িয়ে ডাক দিচ্ছেন, জয় বাংলা। ‘আমার ভাইয়েরা’ শিরোনামে মাননীয়া শেখ হাসিনার লেখা পড়ে আমার মনে হয়েছে আমিও যেন রেসকোর্স ময়দানে ছিলাম সেদিন…
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, শ্রদ্ধেয়া শেখ হাসিনা লিখছেন,
“রেসকোর্স ময়দান। সকাল থেকেই দলে দলে লোক ছুটছে ময়দানের দিকে। গ্রামবাংলা থেকে মানুষ রওনা দিয়েছে ঢাকার পথে। সকাল দশটা-এগারোটার মধ্যেই আমরা শুনতে পারলাম, ময়দানে লোকের আনাগোনা শুরু হয়েছে। একটা মঞ্চ তৈরি হচ্ছে, খুবই সাদাসিধে মঞ্চ। মাথার উপর কোনও চাঁদোয়া নাই, শুধু একটা খোলা মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। পশ্চিম দিকে মুখ করে মঞ্চটা তৈরি। পূর্ব দিকে রাস্তার পাশ থেকে একটা সিঁড়ি তৈরি করা হয়েছে। মাঠ জুড়ে বাঁশ পুঁতে পুঁতে মাইকের হর্ন লাগানো হচ্ছে। যতই মানুষ বাড়ছে, ততই হর্ন লাগানো হচ্ছে। মাইক যারা লাগাচ্ছেন, তাঁরাও যেন হিমশিম খাচ্ছেন, কোনও কূলকিনারা পাচ্ছেন না। কত মানুষ হবে? মানুষ বাড়ছে আর তারা তার টানিয়ে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগের ভলান্টিয়াররা খুবই তৎপর। মানুষের মাঝে প্রচণ্ড এক আকাঙ্ক্ষা, শোনার অপেক্ষা, কি কথা শুনাবেন নেতা। যারা আসছেন, তাঁদের হাতে বাঁশের লাঠি, নৌকার বৈঠা ও লগি। তাঁদের মুখে-চোখে একই আকাঙ্ক্ষা— স্বাধীনতা। দীর্ঘ তেইশ বছরের শোষণ-যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষা এ মানুষগুলির মুখে-চোখে। এ ময়দানে শরিক হয়েছে সর্বস্তরের মানুষ— নারী, পুরুষ, কিশোর-কিশোরী, ছাত্র-শিক্ষক, কিষান-কিষাণী, জেলে, কামার, কুমার, তাঁতি, রিকশা ওয়ালা, নৌকার মাঝি, শ্রমিক— কোনও সম্প্রদায়ের মানুষ ঘরে নেই। ঢাকা শহরে এত মানুষ কোথা থেকে এলো? এ এক অভূতপূর্ব দৃশ্য, বিস্ময়কর চিত্র।”
এ যে আমাদের ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ডের কথা। সকাল থেকে ট্রেনে বাসে মানুষ আসছিল, এসেই যাচ্ছিল। গান গাইছিল,
শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি,
বাংলাদেশ, আমার বাংলাদেশ।
সংবাদ পাঠক বিভূতি দাস আবেগদীপ্ত গলায় কী অপূর্ব ধারাবিবরণী দিয়েছিলেন রেডিওতে। পরে তা বাজানো হয়েছিল কয়েকদিন। আমি শুনেছি বাড়িতে বসে।
“আমি বিভূতি দাস ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড থেকে বলছি। বিরাট এই প্রান্তর, যতদূর দৃষ্টি যায়, শুধু মানুষ আর মানুষ আর মানুষ…।” মিটিং’এ মঞ্চে ভাষণ দিয়েছিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী।