দমদম জংশন ষ্টেশন থেকে ট্রেনে উঠলাম জনা ছয় যুবক। ট্রেন চলতে লাগল, পার হতে লাগল বারাসত, অশোকনগর, মসলন্দপুর, হাবড়া, গুমো, গাইঘাটা, ঠাকুরনগর… ট্রেন ভর্তি হয়ে যেতে লাগল। জয় বাংলা শ্লোগান দিয়ে উঠতে লাগল যুবক আর মধ্যবয়সীরা। তাঁদের গায়ে যেন ওপারে ফেলে আসা খাল বিল, জন্মভূমির কাদামাটির গন্ধ। সবাই যাচ্ছেন সীমান্তে। পাকিস্তান আর থাকবে না। বাংলাদেশের পতাকা নিয়ে এসেছেন একজন। বনগাঁ থেকে সেই পতাকা কাঁধে মিছিল চলল সীমান্ত পর্যন্ত। শেখ মুজিবের ডাকে আমরা চলেছি যেন যুদ্ধে। সীমান্তের চেকপোস্টে আটকেছে সীমান্ত প্রহরীরা। কিন্তু তারাই পথ দেখিয়ে দিল, কোন দিক দিয়ে ‘জয় বাংলা’য় ঢুকতে হবে। বাংলাদেশের নাম তখন ‘জয় বাংলা’। আমাদের এবার লুকিয়ে যাওয়া। কোন গ্রাম, খাল বিল পেরিয়ে সীমান্তের ওপারে এক মুক্তি শিবিরে পৌছলাম যখন বেলা দুপুর। জয় বাংলা ডাক দিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলেন মধ্যবয়সী একজন। তাঁকে আমার স্পষ্ট মনে আছে, লুঙ্গি আর গেঞ্জি, হাতে বন্দুক। শেখ মুজিবের ডাকে এসেছি। জয় বাংলা। যা দেওয়ার দিয়ে ফিরে এসেছিলাম কেন না শুনছিলাম পাক বাহিনী যশোরেরও এপারে ঝিনাইদহে এসে গেছে। এদিকে আসছে তারা। একটু মাটি নিয়ে ফিরেছিলাম। মাটি দেখে মা আর বাবার চোখে জল। কতকাল বাদে মনে পড়ল সেই ফেলে আসা গ্রাম আর নদীর কথা। বাড়ির সকলে জিজ্ঞেস করতে লাগল সীমান্তের ওপারের কথা। আমি যেন দেখে এসেছি বাড়ির পিছনের কাঁটাল গাছটি। আমি যেন দেখে এসেছি চুষির আম গাছটি। আমি যেন কথা কয়ে এসেছি, এজার শানা, মোজার শানার সঙ্গে। তাঁরা ছিলেন বাবার বন্ধু। সেই মাটিকে মা তাঁর বাপের বাড়ি, শ্বশুরবাড়ি ধুরোল গ্রামের মাটি বলে লক্ষ্মীর পটের পাশে রেখে দিল।
কলকাতার যে অঞ্চলে বাস করি, আমাদের প্রতিবেশী পাহাড় প্রমাণ লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়। তাঁকে নিয়ে এসে ১লা বৈশাখ এক সভা করলাম পার্কে। লোক ভেঙে পড়েছিল। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, জীবনানন্দ পাঠ হলো। শেখ মুজিবের মুক্তির দাবী তোলা হলো। কতবার যে আমরা জয় বাংলা বললাম। পিতৃপুরুষের মতো লেখক, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বললেন মিনিট ৪৫ কিংবা এক ঘন্টা। আমরা বাঙালি। আমাদের ভাই, বন্ধু আত্মজ যুদ্ধে নেমেছে। মুক্তির জন্য এই যুদ্ধ। এ যুদ্ধ আমাদের যুদ্ধও। মুজিবর আমাদের প্রাণের মানুষ। মুজিবরের ডাক আমরাও শুনেছি যে, কারণ আমাদের ভাষা বাংলা। আহা সেই পয়লা বৈশাখের কথা এখনো মনে পড়ে। বীরভূমের সন্তান, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সেই বক্তৃতা লিখে রাখিনি, তখন রেকর্ড করার ব্যবস্থাও ছিল না। তিনি স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে বলেছিলান, ঋজু মানুষ, সটান দাঁড়িয়ে আছেন মঞ্চে। আমরা মুগ্ধ হয়ে শুনছি। মুগ্ধ হয়ে শুনছে সমস্ত পাড়া। না, তিনি দেখে যেতে পারেননি বাঙালির মুক্তি, বঙ্গবন্ধুর ফিরে আসা। ঐ বছরে ১৪-ই সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন। তখনো যুদ্ধ চলছে, বাংলাদেশের খালে বিলে মাঠে প্রান্তরে, গাঙে, গাঙ পাড়ে যুদ্ধ চলছিল তখন। মানুষ মরছিল। মানুষ সীমান্ত পার হয়ে যশোর রোডের ধারে ঝুপড়ির বাসিন্দা হয়েছিল। সেই মানুষ নিয়েই তো গিন্সবার্গের কবিতা।
তারপর? যুদ্ধ চলল। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত পেরিয়ে শীতে মুক্ত হলো সে দেশ। নতুন দেশের জন্ম হলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর যে ডাক দিয়েছিলেন, তা অক্ষরে অক্ষরে পালন করল বাংলাদেশের মানুষ, মুক্তিযোদ্ধারা। মুক্তিযুদ্ধই জন্ম দিয়েছিল বাংলা নামের একটা দেশের। ভারত পাশে দাঁড়িয়েছিল। ২১শে ফেব্রুয়ারি হলো আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। সব মিলিয়ে বাঙালির নিজস্ব একটা দেশ হলো। অনেক পরাজয়ের পর বাঙালি জিতল সেই প্রথম। তার আগের ইতিহাস তো শুধু পিছু হটার। বঙ্গবন্ধুর ডাকে যে জয় তা এক নতুন দেশের জন্ম দিল। মহৎ মহৎ মহৎ। সেই জয় যা কি না এমন একটা দেশের জন্ম দিল যে দেশের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা। সরকার চিঠি দেয় বাংলায়। মানুষ বাংলায় চিঠি লেখে প্রধানমন্ত্রীকে। সরকারি অফিসে গিয়ে বাংলায় কথা বলতে পারে সাধারণ মানুষ, প্রান্তিক মানুষ। বাংলা জানলে কাজ হয়। সর্বত্র বাংলা বাংলা আর বাংলা। আর এই ভাষা, এই ভাষার গান, এই দেশের সংস্কৃতি, খাদ্যাভ্যাস সব নিয়ে দেশটা বিপুল হয়ে উঠল ক্রমশ। আমাদের এই পারে এই অভ্যাস থেকে আমরা ক্রমশ দূরে সরে যাচ্ছিলাম। এখন তো বাঙালির খাদ্যেই থাবা বসিয়েছে শাসকের খবরদারি। মছলিখোর অপবাদটি আমরা সহ্য করে মাছের ঝোলেই ভাত মাখি। একটা জাতি যা নিয়ে বিশিষ্ট হয়, তাকে সব সময় রক্ষা করা এই ভুবনায়নের দিনে কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ভুবনায়নের কথা তো আজকের কথা, ১৯৫৫ সালে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান গণ পরিষদে শেখ মুজিব এই কথা বলেছিলেন,
“স্যার (গণপরিষদের প্রেসিডেন্ট), আপনি দেখবেন ওরা “পূর্ব বাংলা” নামের পরিবর্তে “পূর্ব পাকিস্তান” নাম রাখতে চায়। আমরা বহুবার দাবি জানিয়েছি যে; পাকিস্তানের পরিবর্তে আপনাদের বাংলা (বঙ্গ) ব্যবহার করতে হবে। “বাংলা” শব্দটার একটি নিজস্ব ইতিহাস,ঐতিহ্য আছে। আপনারা এই নাম আমাদের জনগণের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে পরিবর্তন করতে পারেন। আপনারা যদি ঐ নাম পরিবর্তন করতে চান তাহলে আমাদের বাংলায় আবার যেতে হবে এবং সেখানকার জনগণের কাছে জিজ্ঞেস করতে হবে তারা নাম পরিবর্তনকে মেনে নেবে কিনা।”