হ্যাঁ, সত্যিই মনে হয়েছিল শেখ মুজিবই নিরুদ্দিষ্ট নেতাজি সুভাষ। তিনিই। না হলে এমন ডাক কে দেবেন? এমন অসাধ্য কে সাধন করবেন? আর আমার মনে হতে লাগল, শেখ মুজিব ডাক দিয়েছেন, আমাকে যেতে হবে যুদ্ধে। শেখ মুজিবকে ২৫শে মার্চ রাত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলিটারি গ্রেপ্তার করে দূর পশ্চিমে করাচি নিয়ে যায়, কিন্তু তিনি যে ডাক দিয়ে গেছেন, তা সীমান্তের অলীক প্রাচীর ভেদ করে এপারে এসে পৌঁছেছে। মার্চ মাসের শেষ, পূর্ব পাকিস্তানের খাল বিলে আশ্রয় নেওয়া পরিযায়ী বুনো হাঁসের দল ফিরছে নিজ দেশে, সাইবেরিয়ার দিকে, তারা রাতের আকাশে উড়তে উড়তে খবর দিয়ে যাচ্ছিল, জয় বাংলা, বাংলার জয়…, বুনো হাঁসের ডাক শুনেছিলাম এক গভীর রাতে। পূর্ববাংলা থেকে, হাওর-বাওরের দেশ থেকে তারা খবর নিয়ে ফিরছিল, যুদ্ধ লেগেছে যুদ্ধ, মানুষের মুক্তির যুদ্ধ, শেখ মুজিবকে নিয়ে গেছে তারা অনেক দূরে, বন্দী করে রেখেছে এক গুহার ভিতর। তার নামে জেগেছে মানুষ, খালবিল নদীনালা গাছ-গাছালি নিয়ে মানুষজন।
শোনো একটি মুজিবরের থেকে লক্ষ মুজিবরের কন্ঠস্বরের ধ্বনি, প্রতিধ্বনি
আকাশে বাতাসে ওঠে রণি,
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ…
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবরকে নিয়ে গান বেঁধেছেন অংশুমান রায়, গেয়েছেনও তিনি। রেডিওতে সেই গান শুনে আমি শিহরিত। আমার ভিতরে মুক্তিযুদ্ধ প্রবেশ করছে। আমি ভারতীয়। কিন্তু বাঙালি। বাঙালির জাতিসত্ত্বা প্রোথিত হয়ে যাচ্ছে আমার ভিতর। শেখ মুজিবর রহমানকে পাকিস্তানিরা নিয়ে গেছে পশ্চিমে। আমি মনে মনে নিজেই লক্ষ মুজিবরের একজন হয়ে উঠেছি। ঘুমের ঘোরে কী বলছি কে জানে, মা ডাকছেন, কী বলছিস? …এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
মনে পড়ে তখন আমার এই শহর কলকাতা উত্তাল মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে। স্কটিশ চার্চ কলেজে পড়ি, দুপুরে পশ্চিম পাকিস্তানিদের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে, বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে মিটিং। মিছিল। কলেজে কী অপূর্ব বক্তৃতা শুনলাম কবি, অধ্যাপক তরুণ সান্যালের। একটি ঘন্টা তিনি বলেছিলেন, নাকি তারও বেশি, শেখ মুজিবের জন্য যেমন ছিল উৎকণ্ঠা, তেমনি ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সমর্থন। মুক্তিযুদ্ধ ছিল যেন শেষ যুদ্ধ। শেখ মুজিব ডাক দিয়েছেন, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। বছর কুড়ির আমি করব কী? ফুটছি শুধু ফুটছি। রেডিওতে দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংবাদ পাঠ শুনছি। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম নিয়ে কথিকা শুনছি। তখন রেডিও আর সংবাদপত্রই ছিল জানার একমাত্র উপায়।
আমি কয়েকজনকে জোগাড় করে চাঁদা তুলতে বেরলাম পাড়ায়। অবাঙালিরা মুখ ফেরালেন কিছু কিছু, আবার দিলেন যে কেউ কেউ তাও মিথ্যে নয়। বাঙালিরা সবাই যে দিলেন তা নয়, অনেকে দিলেন, অনেকে দিলেন না। জিজ্ঞেস করলেন, কী করব আমরা? আমরা কি মুক্তিযুদ্ধে যাব? অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছেন আমাদের। নীলু, কালু, লালু, বংশীদের নিয়ে চাঁদা তুলতে আসা নিরীহ ছেলেটিকে। নীলু, কালুদের বাড়ি বেলগাছিয়ার বস্তিতে। কারো বাবা কলমিস্ত্রি, কারো বাবা রাজ মিস্ত্রি। উদ্দীপ্ত নীলু বলল, হ্যাঁ, মুক্তিযুদ্ধে যাব।
বাঙালির মহাযুদ্ধ ওপারে যে শুরু হয়েছে এই কথা বলতে লাগলাম পাড়ার বাড়িতে বাড়িতে গিয়ে। দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় আর অংশুমান রায় তখন এপারের বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করছেন। আমি বাঙালি আগে। আমাদের ফেলে আসা মাতৃভূমি আক্রান্ত। মাতৃভূমির কোনো খোঁজই রাখতাম না। কিন্তু এখন চিনলাম। চিনিয়েছেন শেখ মুজিবর। বঙ্গবন্ধু। যুদ্ধ চলছে। আমি চাঁদা তুলতে লাগলাম। হ্যাঁ, এও সত্য, আমার সহপাঠী বন্ধুরা, পাড়ার ভদ্রলোক পরিবারের বন্ধুরা কেউ তেমন এল না, যারা আমার সঙ্গী হলো, সেই সব গরিব বস্তিবাসীর সন্তান, নীলু, কালু, বংশী, লালু, পল্টুরা বলল, বলল, চলো আমরাও যাব যুদ্ধ করতে। কেউ কেউ বলল, পেটো বোমা বানিয়ে নিয়ে যাবে কি না। তারা ভেবেছিল পেটো বোমা দিয়ে খান সেনা মারবে। আমিও কি তা ভাবিনি? আমি নেতা, হ্যাঁ বললেই সোরা, গন্ধক, লোহাচুর ইত্যাদি মাল-মশলা তারা কিনে আনবে, বাড়িতে বসে সুতলি দড়ি দিয়ে বোমা বেঁধে সীমান্তে যাবে, দিয়ে আসবে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে। না, তা হয় না। যদিও সেই ৭১-এর কলকাতায় পেটো বোমা প্রায় কুটির শিল্প। তবুও ‘না’ বললাম, আগের বছর বোমা বাঁধতে গিয়ে এই এলাকার দাপুটে মস্তান লখিয়া মারা গেছে বিস্ফোরণে। আবেগপ্রবণ আমি তো আসলে ভীতু, সেই ভয় থেকে বললাম, না, পেটো বোমা দিয়ে যুদ্ধ হয় না। বরং ফার্স্ট এইড নিয়ে যাই। এই পরামর্শ পাড়ার সঙ্গীত শিল্পী গোপালদা দিলেন। তিনি গুনগুন করছেন অংশুমান রায়ের গান। তিনি গলা ছেড়ে গাইছেন, আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি…। তিনি গাইছেন, আজি বাংলাদেশের হৃদয় হতে কখন আপনি…। গোপালদা যা বলছেন তাই হলো। সেই টাকায় প্রাথমিক শুশ্রুষার ওষুধ, ডেটল, বেঞ্জিন, তুলো, ব্যান্ডেজ, আর কী কী কেনা হলো। বনগাঁ লোকাল ধরে বনগাঁ চললাম। উদ্দেশ্য হরিদাসপুর সীমান্ত, সীমান্তের ওপার দিয়ে যশোর যেতে হয়, যশোরে আমার কাকিমার বাপের বাড়ি, ছোটবেলা থেকে তাই শুনে আসছি। আর মা বললেন, যশোরের আগে নাভারন বলে একটা জায়গা আছে, সেখান দিয়ে সাতক্ষীরে যাওয়া যায়। মা আরো বললেন, যশোরের কাছেই সাগরদাড়ি। মাইকেল মধুসূদন দত্তের বাড়ি…, সেই মহাযাত্রার আগের রাতে মা আমাকে এসব বললেন। আর বললেন, সাবধানে যাবি। মা আমার মাথায় হাত রেখেছিলেন।