***
উপরের কথাগুলি আফসার শুনলই না। বলল, আমি যাই।
কোথায় যাবে ?
চুপ করে থাকল। দেখি পাশে কেউ নেই। আমার ঘুম ভাঙল। ভোরের মেঘলা করা আবছা আলো ফুটেছে তখন। আফসার আমেদ কিছু বলতে এসে ফিরে গেছে। আসলে মুখ ফুটে কোনোদিনই সে কিছু বলতে পারত না। এই ভোরেও না। সকালে প্রদোষের অন্ধকার নেমেছে। মেঘে ভরেছে আকাশ। এক ফোঁটা দু ফোঁটা জল…।
শতবর্ষের তর্পণ
মুক্তিযুদ্ধের আগে সীমান্তের ওপার ছিল আমার কাছে এক অলীক ভূখণ্ড। আমাদের ফেলে আসা গ্রাম, নদী আর আমাদের নেই, মায়ের কাছে এই কথা শুনে আমি তাঁর দুঃখ আর কান্নাকেই যেন ধারণ করেছিলাম উত্তরাধিকার সূত্রে। পূর্ব পাকিস্তান, আয়ুব খাঁ, ইয়াহিয়া খাঁ, ভারত পাকিস্তানের সেই ১৯৬৫-র যুদ্ধ, ব্ল্যাক আউট, প্যাটন ট্যাঙ্ক, মিগ বিমান, স্যাবার জেট এসব দেখতে দেখতে শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। পূর্ব বাংলার কোনো খোঁজ তেমন পেতাম না। ভিনদেশ ভিনদেশই হয়ে ছিল। শত শত যোজন দূর যেন, শুধু আমার মা রেডিও পাকিস্তান শুনতেন, তখন শোনা যেত মনে হয়। মা খবর দিতেন সাতক্ষীরেতে কী হলো, কপোতাক্ষ নদে কোথায় ব্রিজ হলো। এই সব সংবাদই ছিল তাঁর কাছে আশ্রয়। এই সব সংবাদ কবিতার সুষমায় ভরা থাকত তাঁর কাছে। মুক্তিযুদ্ধই আমাকে প্রথম জানাল বাঙালি যুদ্ধে নেমেছে পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে। যাদের নিয়ে তারা আলাদা হয়েছিল, কিংবা হাড়ি ভিন্ন হয়েছিল, হাড়ি আলাদা করা হয়েছিল, তাদের বিরুদ্ধেই যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে। আর তার নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান। নেতাজি সুভাষচন্দ্রের পর এক দেশনেতা, সব অর্থে বাঙালি, যিনি বলতে পেরেছিলেন, আমাদের সংগ্রাম স্বাধীনতা সংগ্রাম। নেতাজির সেই ডাক, আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব তা যেন ভাষার যাদুতে অন্য রকমে আমাদের কাছে নিয়ে এলেন শেখ সায়েব। সেই যে ৭-ই মার্চের ডাক, ‘ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল’, ‘ভাইয়েরা আমার, সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম’— মনে হয়েছিল শৌলমারীর সাধু নন, নেতাজি ফিরেছেন শেখ মুজিবর হয়ে। শৌলমারীর সাধুর কথা ওপারের মানুষ জানেন কি না বলতে পারি না। আমাদের বাল্যকালে সংবাদপত্রে শৌলমারীর এক সাধু নিয়ে অনেক চর্চা হয়েছিল। প্রায়ই সংবাদপত্রের বিশেষ বৈকালিক সংস্করণ (টেলিগ্রাম) বেরত “নেতাজি ফিরে এলেন” এই শিরোনাম নিয়ে। সেই টেলিগ্রাম মুহূর্তে শেষ। গত শতকের ছয়-এর দশকের প্রথম ভাগে মানুষ বিশ্বাস করত নেতাজি ফিরে আসবেন এবং বাঙালির সমস্ত দুর্গতির অবসান ঘটাবেন। নেতাজি ফিরেছেন এবং তিনি কোনো এক শৌলমারীতে সাধুবেশে আছেন, সময়েই আত্মপ্রকাশ করবেন। ‘শৌলমারীর সাধু কি নেতাজি’ এই নামের একটি গ্রন্থ হাজার হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। পরে ধীরে ধীরে এই সংবাদের অবসান ঘটে। কিন্তু শেখ মুজিবরের ডাক শুনে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কথা শুনে সদ্য যুবা এই অমরের মনে হয়েছিল, সুভাষ ঘরে ফিরেছেন। সময়ে ফিরেছেন। ওপারে বাঙালি দলিত হচ্ছে, নিপীড়িত হচ্ছে, সুভাষ ঘরে ফিরেছেন। খবর আসছে সীমান্তের ওপার থেকে।
মুক্তিযুদ্ধের আঁচ আমরা পেলাম। সমস্ত পৃথিবী পেল। খবর পেলাম শেখ মুজিবের ডাকে বাঙালি যুদ্ধে নেমেছে। রক্ত দিচ্ছে বাঙালি। বাঙালিকে ১৯৪৭-এর পর থেকে মারছে পশ্চিম পাকিস্তানিরা। বাঙালি এবার রুখে দাঁড়িয়েছে। মিথ্যে হয়ে গেছে ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ। মুক্তিযুদ্ধের সময় চারপাশে অবাঙালি অধ্যুষিত কলকাতা শহরে বড় হয়ে ওঠা আমি নিজে জানলাম বুঝি সকলের আগে আমি বাঙালি। বাংলা ভাষা আমার ভাষা। এই ভাষা রক্ষার দাবীতেই পূর্ব পাকিস্তান হয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। উদ্বাস্তু আসছে হাজারে হাজারে। তাদের জন্য সলটলেক বালির মাঠে শিবির করা হয়েছে। তখন ওই নগর গড়ে ওঠেনি। ভেড়ি বুঁজিয়ে ফেলে রাখা হয়েছে ধূ ধূ বালির মাঠ। যাই হোক তখন অ্যালেন গিন্সবারগ কবিতা লিখছেন যশোর রোডের ধারে আশ্রয় নেওয়া উদ্বাস্তু পরিবার নিয়ে, জর্জ হ্যারিসন রবিশঙ্কর কনসার্ট করছেন বাংলাদেশের সমর্থনে। হুমড়ি খেয়ে আনন্দবাজার যুগান্তর বসুমতী, অমৃতবাজার পত্রিকা পড়ছি। বাংলাদেশ বাংলাদেশ…
My friend came to me
With sadness in his eyes
Told me that he wanted help
Before his country dies
Although I couldn’t feel the pain
I knew I had to try
Now I’m asking all of you
Help us save some lives
Bangla Desh, Bangla Desh
Where so many people are dying fast
And it sure looks like a mess
I’ve never seen such distress
Now won’t you lend your hand
Try to understand
Relieve the people of Bangladesh
Bangladesh, Bangladesh
আমি কি এই আর্ত বাঙালির কেউ নই? খবরের কাগজ আর রেডিও আমাকে বদলে দিতে লাগল। রেডিও কত মধুর তখন। আমি উনিশ পেরিয়ে কুড়ি, তখন একদিন একটি খবর বেরিয়েছিল, বরুণ সেনগুপ্ত সাতক্ষীরে গিয়ে ফিরে এসেছেন। সাতক্ষীরেতে যে আমাদের বাড়ি। তা অলীক ভূখণ্ড নয়। খুব কাছে। বসিরহাট পেরুলেই, ঘোজাডাঙা বর্ডার দিয়ে একটুখানি। সেখানে তাহলে যাওয়া যায়। সেই ভূখন্ড অলীক নয়। সীমান্ত দূরে ঠেলে দেয় এক এক ভূখণ্ডকে। যোজন যোজন দূর হয়ে যায় পাশের গ্রাম, পাশের গঞ্জ। তাইই ভাবতাম কত দূর সেই সাতক্ষীরে, কপোতাক্ষ আর মায়ের কাছে শোনা ময়মনসিংহ, যমুনা, টাঙ্গাইল, কালিহাতি, নেত্রকোণা, গারো পাহাড়। যোজন যোজন দূর। কোনোদিন তা আর খুঁজে পাওয়া যাবে না।