আফসার আমেদ, সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত হাওড়া জেলার বাগনানবাসী এক যুবক বাঙালি মুসলমান সমাজের বিবাহের গান সংগ্রহ করে সুখ্যাত পরিচয় পত্রিকায় নিয়ে এসেছিলেন সম্পাদক দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে ১৯৭৮ সালে। সেই প্রবন্ধ পড়ে সম্পাদক অবাক। বিশ্বাসই হয় না, এই যুবক এমন গভীর ভাবে অনুধাবন করেছে বিয়ের গানের ভিতরের আনন্দ এবং অশ্রু। সেই লেখা থেকেই তরুণ লেখক আফসার আমেদ চোখে পড়েন লেখক অমলেন্দু চক্রবর্তী এবং দেবেশ রায়ের। নানা সাহিত্যপত্রে আফসারের আত্মপ্রকাশে এই দুই অগ্রজের স্নেহ জড়িয়ে আছে। আফসারের গল্প লেখা শুরু তখন। প্রথম প্রকাশিত গল্প জলস্রোতে জনস্রোতে। তারপর থেকে পরিচয়, কালান্তর, বারোমাস, প্রতিক্ষণ, সারস্বত ইত্যাদি সাহিত্য পত্রে নিয়মিত লিখতে শুরু করেন। তাঁর লেখায় এল প্রায় অচেনা বাঙালি মুসলমানের অত্মকথাই যেন। কী অপূর্ব তাঁর দেখা। আফসার আমেদ বিশিষ্ট হয়েছিল তার অন্তর্দৃষ্টির জন্য। কালান্তর শারদীয়তে আফসার তাঁর প্রথম উপন্যাস লেখে ১৯৮০ সালে, ঘরগেরস্তি। সাহিত্যের ভালো পাঠক ঘুরে তাকিয়েছিলেন এই নবীন লেখকের দিকে। এরপর প্রতিক্ষণ সাহিত্য পত্রে আফসার আমেদ যে উপন্যাস লেখে গত শতকের আটের দশকের মাঝামাঝি, ‘আত্মপরিচয়’ নামের সেই উপন্যাসেই বিস্মিত করে অনুসন্ধিৎসু পাঠককে। বাঙালি মুসলমান নারীর জীবন ছিল সেই অসামান্য আখ্যানে। ছিল বাঙালি মুসলমানের আত্মপরিচয় উন্মোচনের এক নিদর্শন। এক ভয়ানক হত্যাকান্ডে শুরু সেই উপন্যাস। অন্ধকার রাত্রি। ধনী গৃহস্তের পুত্রবধূ হত হয়েছে। তার গোর কাটতে বসে আছে গ্রামের সবচেয়ে গরিব মানুষটি। আমি এখনো ভুলতে পারিনি সেই অংশগুলি। গোর কাটার মানুষটি হয়ে উঠেছিল প্রধান চরিত্র। আর মুসলমান নারীর অবস্থান ওই সমাজে যেমন তার অন্তর্ভেদী বিবরণ। আফসারের ওই উপন্যাস পড়ে মুসলমান কেন হিন্দু নারীর অসহায় অবস্থাও উপলব্ধ হয়। আফসার ওই ভাবে তার নিজস্ব গণ্ডীর বাইরে চলে যেতে পেরেছিল। তখন থেকে আফসার আমার পাঠ্য তালিকায়। এরপর আফসার ক্রমশ খ্যাতিমান হয়ে উঠতে থাকে। আলাপ হলো লাজুক একটি যুবকের সঙ্গে। সেই আলাপও বছর ৩৫। উদার মানবিকতা তার দর্শন। আর সমস্ত রকম ধর্মীয় কুসংস্কারের বিপক্ষে। আফসার আমাকে তার নিজের কথা বলত। সামান্য ছিল তাঁর জীবিকা। লেখার জন্য ত্যাগ করেছে। সাধনা করেছে। তাঁর লেখার পটভূমি বাগনান এবং তার আশপাশ। হ্যাঁ,আফসার আমেদ বাঙালি মুসলমান জীবনের বিশ্বস্ত চিত্রকর। হ্যাঁ, চিত্রময় তাঁর লেখা। ধানজ্যোৎস্না উপন্যাস পড়লে তা ধরা যায়। মনে হয় এক কবির লেখা উপন্যাস পড়ছি। যা কিছু সুন্দর, তার সঙ্গে কবিতার তুলনা করতে ভালবাসি আমরা। ধানজ্যোৎস্না উপন্যাসের কাহিনি নিয়ে ছবি করেছিলেন মৃণাল সেন। ছবির নাম, আমার ভুবন। এরপর খণ্ড বিখণ্ড, কলকাতার বই বাঁধাই করেন যাঁরা তাঁদের জীবন নিয়ে একটি উপন্যাস লেখেন আফসার। ‘অন্তঃপুর’ নামের উপন্যাসটি ছিল মুসলমান নারীর অন্তঃপুরের কথা। গত শতকের শেষদিকে আফসার আমেদের উপন্যাসে একটি বড় বাঁক আসে ‘বিবির মিথ্যা তালাক তালাকের বিবি এবং হলুদ পাখির কিসসা’ রচনার পর। মুসলমান বাঙালির জীবনে অনেক রকম রূপকথা, কিসসা, গুজব, কল্প-কাহিনি যা ছড়িয়ে ছিল পথের ধূলায় আফসার আমেদ যেন তা কুড়িয়ে আনতে থাকে। লেখকের এই অদ্ভুত যাত্রা ছিল বাংলা উপন্যাসের এক নতুন পথে। হ্যাঁ নিভৃতচারী লেখক সকলের অজান্তেই সেই কাজটি করে যেতে থাকে। আফসার আরম্ভ করে কিসসা সিরিজ রচনা। বিবির মিথ্যা তালাক…রচনার পর, কালো বোরখার বিবি কুসুমের গন্ধ ও চল্লিশজন লোক। তারপর আশ্চর্য বশীকরণ কিসসা, মেটিয়াবুরুজে কিসসা, একটি ঘোড়সওয়ার কিসসা, হিরে ও ভিখারিনি সুন্দরী রমণী কিসসা।এই উপন্যাসগুলিতে বাঙালি মুসলমান রমণীর সামাজিক অবস্থানের কথা আছে, আছে ধর্মীয় নিগড়ের কথা। তিন তালাক যে কত নিষ্টুর এক জীবন-চর্চা তা আফসারের লেখার ভিতরে নানা ভাবে এসেছে। প্রতিক্ষণ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘রক্তলজ্জা’ নামের একটি গল্পের কথা মনে পড়ছে, রক্তলজ্জা গল্পের ‘হাসান’ও ‘ফতিমা’কে ভুলিনি আমি। এই গল্প এক আশ্চর্য প্রেমের, যার সঙ্গে মিশে থাকে ধর্মীয় বিশ্বাস, বিশ্বাসের পবিত্রতা এবং নিগড়ও। নারী পুরুষের সম্পর্কের। একটি সামাজিক সম্পর্ক রক্তের ভিতরে প্রবেশ করেছে, তাকে নানা ভাবে নানা কোণ থেকে দেখেছেন আফসার আমেদ। এই দেখা মানবিক। ধর্ম যেভাবে মানুষের জীবনে জড়িয়ে থাকে, তা লিখেছেন আফসার। সেখানে তাঁর দেখা সম্পূর্ণ আলাদা। মৌলিক। রক্তলজ্জা গল্পের ফতিমার স্বামী শাকিল। ফতিমা ভালোবাসে চাচাতো দেওর হাসানকে। হাসান দুবছর বিয়ে করেছে। তার বউ সেলিমা ভালো মেয়ে। কিন্তু সন্দেহ না করতে করতে সন্দেহের দিকে ধাবিত হয় তার মন। হাসানকে যখন জেরা করে সেলিমা, হাসান কোরান ছুঁয়ে বলে সে ফতিমার ঘরে যায়নি। এই কথা ফতিমা শুনতে পায়। তাদের তো একই ভিটেতে বসবাস। মিথ্যে বলল হাসান আল্লার কসম খেয়ে। হাসান কোরানের পবিত্রতার বিশ্বাসে আঘাত করেছে। ফতিমা যন্ত্রণায় দুমড়ে যায়। এ এক আশ্চর্য গল্প। ফতিমা মনে মনে হাসানকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিতে চায়। কেন না হাসান তার প্রেমকে স্বীকার করেনি, কোরান ছুঁয়ে মিথ্যে বলতে পেরেছে। জানালা বন্ধ করতে গিয়ে আঙুল ছেঁচে রক্তাক্ত হয় ফতিমা। রক্তাক্ত হাতে কোরান পাঠে বসে ফতিমা। সে যে রক্তাক্ত তা ভুলেই যায়। রক্তাক্ত তর্জনী কোরানের পৃষ্ঠায় ডানদিক থেকে বাঁদিকে বর্ণমালার নিচে বুলোয় ফতিমা। আহা এমন প্রেম আর প্রত্যাখ্যানের গল্প লেখা হয় কম।