যেখানে আরম্ভ করেছিলাম, সেখানে ফিরে যাই। সেই প্রদোষ কালে। দেখতে পেলাম আফসার আসছে। সেই আগের আফসার। কৃষ্ণকায় সেই মধ্যবয়সী। আমার অনুজ। বসল আমার কয়েক হাত দূরে। সেখানে অন্যরা ছিল। কিন্তু আফসার আমেদের আসা না আসায় তাদের কিছু যায় আসে না। বলল, অমরদা, আপনাকে দেখতে পেলাম।
কেমন আছ আফসার? কথার কথা। কেমন আছে সে মাটির নিচে। এসব কথা জিজ্ঞেস করার কোনো মানে হয় না। বলল, আছি, অমরদা আপনার মনে আছে সব?
কী মনে থাকবে?
আফসার চুপ করে থাকল, বলল, আপনার সেই বাড়ি!
তোমার সেই গল্প আত্মপক্ষ?
ম্লান মুখে হাসল। হ্যাঁ, ঘুরে এসেছি। সব বদলে গেছে। চিনতে কষ্ট হয়েছে।
আফসার একটি একটি গল্প লিখেছিল, ‘আত্মপক্ষ’। তার কথা বলি। আমাদের সেই গল্পের কথা আফসার তুলল। আফসারের বাড়ি বাগনান শহর থেকে ভিতরে, বাইনান গ্রামে। কলকাতার কাছে কোনো আশ্রয় ছিল না। আর আমি তো জন্ম থেকেই ভাড়াবাড়ির বাসিন্দা। আমরা কলকাতার কাছে সল্টলেক সংযুক্ত এলাকা, মহিষবাথান গ্রামে জমি কিনি একসঙ্গে। সামনে পিছনে, একই প্লট। আমি আগে বাড়ি করলাম। এবার আফসার আর আফসারের স্ত্রী নাসিমা গিয়ে উঠল আমার বাড়িতে। ওখানে থেকে নিজের বাড়ি করবে। কিন্তু সেখানে মসজিদের আজান শোনা যায় না। আত্মীয় স্বজন নেই কেউ। আর সেই ২০০২ সালে গুজরাত দাঙ্গাও ঘটে গিয়েছিল। নাসিমা বলল, বাগনানে ফিরে যাবে চেনা জায়গায়। আফসার চলে গেল। আমরা এক সঙ্গে থাকতে পারলাম না। আমিও নতুন বাড়ি প্রায় তৈরির মূল্যে বিক্রি করে দিলাম আফসার জমি বিক্রি করে দিতে। এরপর আফসার বারোমাস পত্রিকায় একটি গল্প লেখে আত্মপক্ষ। আমি পরের শারদীয়তে লিখি আফসারের গল্পের বিপরীতে একটি গল্প, হ্যাঁ বারোমাস পত্রিকাতেই। আফসারের গল্প অসম্ভব ভালো হয়েছিল। আত্মপক্ষ গল্পে বন্ধু অমরদার বাড়িতে পরিবার নিয়ে চলে আসে গল্প কথক। সেই মহিষবাথান, সংযুক্ত এলাকা। গল্প কথকের মনে হয়, তারা মুসলমান, হিন্দু এলাকায় বাড়ি করতে যাচ্ছে, ঠিক হবে কি? সহাবস্থানের ভিতরে যে প্রেম তাইই ছিল জমি কেনা সূত্র। অমরদার সঙ্গে সে জমি কিনেছে। ঠিক করেছে কি? বাগনানে আত্মীয়স্বজন সকলে থাকে, তাদের ছেড়ে একেবারে হিন্দু এলাকায় অমরদার নতুন করা বাড়িতে মুসলমান পরিবারটি থাকতে এসেছে। স্থানীয় মানুষ আসে, আলাপ করে, তারা সকলে হিন্দু। বউগুলিও হিন্দু। মুসলমান এখানে কেউ নেই। লেখক, কথকের বউ নাসিমা খাপ খাইয়ে নিতে পারবে কি? হিন্দু বন্ধুর পরিবার রেখে গেছে কালী ঠাকুরের ছবি, ধুপ-ধুনো, দেবীর গলার মালা শুকিয়ে গেছে। নাসিমা ওই ছবি, ধুপ ধুনো মালা নিয়ে কী করবে? সে তো হিন্দুত্বে বিশ্বাস করে না। ধর্মপ্রাণ মুসলমান নারী। কালী ঠাকুরের ছবি তার ঘরে রাখবে কী করে? সেই ছবি অন্যঘরে খাটের তলায় রেখে দিল। তাতে অনুতাপ হলো স্বামীর। ওঁদের পুজোর দেবী, তাঁকে অনাদরে রাখা কি ঠিক? কিন্তু নাসিমা যে চায় না তার সমুখে কালী ঠাকুরের ছবি থাকুক। নাসিমা যে রাখতে চায় না। আফসারের মনে হয় অমরদা বিষয়টি বুঝবেন। কিছু মনে করবেন না। সমস্যা তার বউ নাসিমার। গভীর রাতে নাসিমাই স্বামীকে জাগিয়ে তোলে, তার দম বন্ধ হয়ে আসছে। আগে এমন হয়নি কখনো। ঘুমতে পারছে না সে। পরদিনও সে অস্থির। তার অস্থিরতা যায় না। চোখে অকারণে জল আসছে। নতুন জায়গা বলে হয়তো। কিছুতেই খাপ খাওয়াতে পারছে না নাসিমা। ফজরের আজানে তার ঘুম ভাঙেনি, তাই মন খারাপ। অথচ তার দুই সন্তান কেমন মিশে যাচ্ছে প্রতিবেশি বাড়ির সমবয়সীদের সঙ্গে। নাসিমা অবশ্য সারাদিনে স্বাভাবিক হয়ে এল কিছুটা। তা দেখে নিশ্চিন্ত লেখক। কেন নাসিমার উদ্বেগ গেছে, সারাদিনে তার মনে হয়েছে গত সন্ধ্যায় যে সে কালী ঠাকুরকে খাটের তলায় চালান করেছিল, তার জন্য পাপ হতে পারে। অন্যের ঠাকুর দেবতাকে অনাদর করেছে বলেই রাতে সে অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন সে দেবীকে তার নিজের জায়গায় ফিরিয়ে আনে। নিজে ঝেড়ে মুছে যথাস্থানে স্থাপন করে ধূপ জ্বালিয়ে দেয়। আফসার সেই মহিষবাথান থেকেই আসছে। আমি বললাম, আফসার আমাদের উপর তোমার অভিমান আছে? আমরা সেভাবে তোমার পাশে দাঁড়াতে পারিনি। কীভাবে দাঁড়াব তাও বুঝতে পারিনি। আমাদের কারোরই সেই সঙ্গতি নেই যা নিয়ে তোমার পাশে দাঁড়াতে পারি।
আফসার বলল, সব ভুলে গেছি অমরদা।
আমি চুপ করে থাকলাম।
আফসার বলল, হেরে গেছি অমরদা।
আমি মাথা নিচু করলাম। পরাজয় আমাদের তা বুঝতে পারছি।
লেখাটুকু বাদ দিয়ে সারাজীবন শুধু হেরেই গেছি।
আসল জায়গায় জিতেছ আফসার।
যাতে না লিখতে পারি, তার ব্যবস্থা ছিল। কথাটা আফসার বলল, না আমার মনে হলো, তা আমি বলতে পারব না। আফসার বলেনি। সে ভুলে গেছে সব। কথাটা উড়ে এসেছে সন্ধ্যার নতুন অন্ধকার থেকে। আমার ভালোবাসার মানুষ, বহুদিনের সঙ্গী, প্রিয় লেখক বন্ধু হেরে গিয়েছে। অসুখ তাকে শেষ করে দিল। হ্যাঁ, প্রাকৃতজনের যাওয়া এমনই হয়। হায়!
***
‘সেই নিখোঁজ মানুষটা’ উপন্যাসের জন্য আফসার গত ডিসেম্বরে সাহিত্য অকাদেমি পুরস্কার পেয়েছিলে। সাত মাসের ভিতরে প্রয়াণ। কোনো সুখ স্বস্তি ওর জীবনে ছিল না। যে সরকারী প্রতিষ্ঠানে ২৪/২৫ বছর চাকরি করেছে তারা পাকা করেনি চাকরি। উদ্দিষ্ট পোস্টে অনভিজ্ঞ মানুষকে নেওয়া হয়েছে ওকে নেওয়া হয়নি। অবসরের কোনো সুবিধা পায়নি। দেখেছি ওকে প্রাপ্য মর্যাদা দেননি ছোটখাট সাংস্কৃতিক আমলা। বাংলা একাডেমি তাকে বঙ্কিম পুরস্কার দিয়েছিল। আফসার নিজ যোগ্যতায় তা পেয়েছিল। অনিরাপদ জীবন ছিল ওর সঙ্গে। ছিল ভয়ানক উদ্বেগ আর অর্থনৈতিক নিরাপত্তা হীনতা। আমি কত কথা শুনেছি ওর মুখে। খুব মৃদুভাষী ছিল। ও ভুলে যেতে পারে, আমি তো ভুলিনি। আমাদের দেশ, সমাজ, রাষ্ট্র একজন গুণী কথাশিল্পীকে রক্ষা করতে পারে না। তার পাশে দাঁড়ায় না।