দিব্যেন্দু পালিতের এই গল্প ক্রমশ ডুবিয়ে নিতে থাকে আমাকে তাঁর মগ্নতায়। মায়ের সঙ্গে বেশি কথা বলতে পারে না দিবাকর। মায়ের অনেক জিজ্ঞাসা, হুঁ, হাঁ করে উত্তর দিয়েই সে হোম ছেড়ে আসে। কদিন আগে কারা যেন মাকে কমলালেবু আপেল দিয়ে এসেছে। দিবাকর তাই কিছু নিয়ে যায় নি। মা একা আর কত খাবে। ফলগুলো পচবে। মায়ের চিঠি আবার আসে। এই চিঠিতেও হোমের আর একজনের মৃত্যু সংবাদ, গিরীনবাবু মারা গেছেন। … মায়ের চিঠিতে আসলে সত্য যেমন থাকে, থাকেও না। তাঁর কাছে কেউ যায় না তেমন। দিব্যেন্দু পালিত আমাদের মুখের সামনে এক আয়না ধরেছেন। যে কথায় আরম্ভ করেছিলাম, তিনি হিমঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে গিয়েছিলেন, মুখগুলি। মনে রেখ কত মুখ। কত রকম মুখ। ফ্রেদেরিকো ফেলিনির একটি ছবি দেখেছিলাম চল্লিশ বছর আগে। অ্যামারকর্ড। কত মুখ দেখেছিলাম সেই ছবির এক এক দৃশ্যে। মনে আছে সেই মুখগুলি। মনে আছে নিঃসঙ্গ সুধা মায়ের কথা। মুখগুলি আমি ভুলতে পারিনি এখনো।দুপুরের খাবার পর মায়ের বুকে পেন হয়েছিল তারপর…। এই গল্পে যেন পুত্র দিবাকরও এক নিরূপায় মানুষ। মা নিরূপায় হয়েও সব কিছু মেনে নিয়েছে। ছেলেদের কথা ভেবেছে, পুত্র কন্যাদের নিষ্ঠুরতাকে আড়াল করেছে। আড়াল করে নিজের কল্পিত সুখ আহরণ করেছে। গল্পটি যতবার মনে করি আর্দ্র হয়ে পড়ি। গল্পের মুখগুলি ভেসে ওঠে চোখের সামনে। ভেসে ওঠে সারি সারি বেতের চেয়ার, অস্পষ্ট মুখগুলি তাকিয়ে আছে গেটের দিকে। গেট পেরিয়ে রাস্তা। ধুলো উড়লে মেঘ ঘনাত, সন্ধে হত তাড়াতাড়ি। ওখান থেকে মায়ের মুখটি মুছে গেছে আজ। এই গল্প আমার স্মৃতি থেকে মুছবে না এক বিন্দুও। দিব্যেন্দুদা, লেখা আর বন্ধুতা নিয়ে আপনি আমাদের সঙ্গেই থাকবেন। লেখকের মৃত্যু হয় না। আমি এখন মুখগুলির পাতা খুলছি। খুলতে খুলতে আমার চোখ ভিজে যাচ্ছে। মুন্নির সঙ্গে সময় কাটাতে চাইছি। কী অপরূপ মুখ মুন্নির। মুখের ছবি তো শুধু মুখেই নয়। অভিব্যক্তিতে, জলের মতো সরল কথায়। আমি সেই অনিল যে মাড়িয়ে দিয়েছিল শিশুটির পা। অভিযুক্ত হয়েছিল শিশুটির উদ্ধত তর্জনীর সামনে। সেই মুখ সারাদিন তাড়িয়ে বেড়ায় অনিলকে। শেষে বাড়ি ফিরে নিজের সন্তানের পায়ের উপর জুতো তুলে দিয়ে তাকিয়ে দেখে তার মুখ।
গতবার মনে হয় শীত বেশিই পড়েছিল। হাড়ে কাঁপুনি দিয়েছিল যেন। তাই হয়তো চুল্লীর আগুনের দিকে অতি বিভ্রমে সারিবদ্ধ যাওয়া প্রিয় মানুষগুলির। দিব্যেন্দুদা, পিনাকী ঠাকুর, মৃণাল সেন, নীরেন্দ্রনাথ… পরপর সকলে চলে গেলেন। এখন ভয়ানক গ্রীষ্ম। চিতার আগুন যেন নেভেনি। মুখগুলি আর ফিরবে না, লকলক করে জ্বলছে। জ্বলুক। গল্প, উপন্যাস, কবিতা থাকবে। আছে। আমরা পড়ছি। আগুন তা পোড়াতে পারে না।
প্রদোষে প্রাকৃতজন
[শিরোনামটি ঔপন্যাসিক শওকত আলির উপন্যাসের। তাঁর প্রয়াণ হয়েছে কিছু মাস আগে। এপারের লেখক, অনুজ প্রতিম আফসার আমেদের প্রয়াণকথা লিখতে গিয়ে তাঁর উপন্যাসের শিরোনামগ্রহণ বাংলাভাষার এই বড় লেখককে স্মরণ করা। প্রয়াত শওকত আলিকে আমার প্রণাম।]
আফসার এল আচমকা। আসার কথা তো ছিল না। তখন ভোরের আলো ফুটছে, না তখন বেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে বলতে পারব না। প্রদোষকালে আলো মরে যায় অমন। প্রত্যুষের আলো অত বিষণ্ণ হয় না। আমি কোথায় ছিলাম বলতে পারব না। সেখানে আরো অনেকে ছিল। পরিচিত অপরিচিত। তাদের অনেকেই চেনে আফসার আমেদকে। আবার চেনেও না। আমি আফসারকে দেখে উল্লসিত। আমিই দেখতে পেলাম আফসার আমেদ আসছে। ফ্যাকাশে নীল একটা শার্ট আর পুরনো টেরিকটনের প্যান্ট। পায়ে রবারের জুতো। কাঁধে ব্যাগ নেই। এমন হতে পারে সে বাংলা একাডেমির উপরতলা থেকে নেমে আসছিল। আবার হতে পারে বাংলা একাডেমি যাওয়ার পথে আমাকে দেখে দাঁড়াল। আমি কি ওই প্রাঙ্গণের বট অশ্বত্থ কিংবা অনামি কোনো গাছের নিচে বসে ফোনে আফসারকে ডেকেছিলাম? আমার অভ্যাস ছিল তেমন। তখন আমার চাকুরিস্থল আলিপুর ছিল। দরকারে অদরকারে আড্ডা দিতে আফসারের কাছে চলে আসতাম। মোবাইল ফোন যখন নিইনি, নিচের রিসেপসন থেকে ইন্টারকমে ফোন করতাম, বাইরে আছি। সে নেমে আসত। তখন সে চারতলায় বসত। বাংলা বই রিভিউ ম্যাগাজিনের দায়িত্বে ছিল। পরে সে নেমে আসে নিচের তলায়। তখন গিয়েই বলতাম বাইরে আছি, তোমার টিফিন হয়ে গেছে? টিফিন করতে পারি আমরা। আফসারকে একদিন, সে অনেকদিন বাদে দেখেছিলাম হাঁটতে গিয়ে বেঁকে যাচ্ছে। এ কী! তোমার কী হয়েছে আফসার।
ডাক্তার দেখাচ্ছি অমরদা, কিছু টেস্ট করতে হবে।
কিন্তু এই আফসার সেই আফসার নয়। বেশ সুস্থ। সেই গত জুলাইয়ের মাঝামাঝি আমাদের শেষ দেখা। বেলভিউ নার্সিংহোমে আমি, নলিনী, সমীরণ দাস গেলাম। আর এসেছিল সন্দীপ নট্ট। নাসিমার সঙ্গে দেখা বেলভিউয়ে। মুখখানি ম্লান। সারাদিন বসে আছে। ওর ছেলে শতাব্দর সঙ্গে দেখা। ১৪০০ বঙ্গাব্দে তার জন্ম, শতাব্দ নাম সেই কারণে। আফসারকে দেখেছিলাম খুব শীর্ণ হয়ে গেছে। সেদিন সারাদিন ধরে ওর পেটে জমা তরল নিষ্কাশন করা হয়েছিল, শতাব্দ বলল। কিন্তু আমাদের দেখে চোখমুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছিল। বেল ভিউয়ের খরচ কী করে চলবে? আমার সঙ্গে এক সন্ধ্যায় সমরেশ রায়ের কথা হয়েছিল। সমরেশদা বলেছিলেন, আফসার বেল ভিউ থেকেই ফোন করেছিল। বিপুল ব্যয় ভারের কথা সমরেশদা তুলতে আফসার বলেছিল, “বেঁচে থাকতে ইচ্ছে করছে যে খুব।” খরচ সামলাতেই পিজিতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। সেখানেই তার শেষের কদিন কেটেছিল। পিজি হাসপাতালে বড় ডাক্তারের অধীনেই ছিল। কিন্তু শরীর জীর্ণ হয়ে গিয়েছিল, দিন ফুরিয়ে এসেছিল। বেঁচে থাকার প্রবল তৃষ্ণা নিয়ে আফসার আমেদ, আমাদের যুগের বড় লেখক বিদায় নিয়েছে এই গ্রহ থেকে। এই গ্রহে কত ব্যবস্থা। প্যাকেজে কত ঝাঁ চকচকে চিকিৎসালয়ে চিকিৎসা হয়। চিকিৎসা খরচের ব্যবস্থা ছিল না তার। বেঁচে থাকার ব্যবস্থা ছিল না ষাটে পা দেওয়া এই প্রতিভাবান লেখকের। সেই ব্যবস্থা বহুদিন ধরেই ছিল না। যেখানে চাকরি ছিল, সেখানে প্রবল অসম্মান ছিল। সেই অসম্মানের সাক্ষীও হয়েছি আমি এক-দুবার। তার চাকরি পাকা ছিল না। অবসরের পর কিছুই পায়নি। অভাব তার সঙ্গী। লিখতে এসেছিল। লিখতে লিখতে চলে গেছে। আরো লেখা ছিল, সেই কারণেই বেঁচে থাকতে চেয়েছিল। সাহিত্য অকাদেমির কাছে আমার প্রস্তাব, পুরস্কৃত লেখকের চিকিৎসা-বীমা করে দিন। সঙ্গীত নাট্য অকাদেমির এই ব্যবস্থা আছে। সাহিত্য অকাদেমির কেন থাকবে না? তাহলে আফসারের চিকিৎসার সামান্য জমা টাকা, অকাদেমি পুরস্কারে পাওয়া টাকা সব চলে যেত না।