দিব্যেন্দুদার সঙ্গে প্রথম পরিচয় আনন্দবাজার পত্রিকার রবিবাসরীয়র ঘরে। সম্পাদক রমাপদ চৌধুরী। দুজনেই খুবই গম্ভীর মানুষ। আমাকে বললেন, পড়েছি লেখা, ভালো। এই পর্যন্ত। রমাপদ চৌধুরীর ঘরে যে আড্ডা হতো তা ছিল শুধুই সাহিত্যের। আমি চুপ করে অগ্রজ বড় লেখকদের কথা শুনতাম। অনুধাবন করতে চাইতাম তাঁদের কথা। কথা শুনতে শুনতে শেখা। দিব্যেন্দুদা আলব্যের কামু ও ফ্রানজ কাফকার কথা বলতেন। আউট সাইডার, প্লেগ, মেটামরফোসিসের কথা বললেন একদিন। তিনি অনুজপ্রতিম তরুণ লেখকদের বলতেন বিশ্ব সাহিত্য বদলে দিয়েছেন এই দুই লেখক, এঁদের পড়। পড়েছি তখন, খুব বেশি নয়, সামান্য, কিন্তু সামান্য পড়ে কথা বলার চেয়ে শোনাই ভালো। ১৯৮২-৮৩ হবে। তাঁর ‘ঘরবাড়ি’ উপন্যাসটি বেরিয়েছে তখন। একটি আত্মহত্যার কাহিনি ছিল তা। বহুতল থেকে ঝাঁপ দিয়েছিল বধুটি। পড়ে স্তম্ভিত হয়েছিলাম। এরপর পড়ি ‘ঢেউ’। তারপর ‘সহযোদ্ধা’। সহযোদ্ধা আগেই লেখা, পরে পড়া। যা লিখেছেন এই কলকাতাকে কেন্দ্র করে। কিন্তু সে লেখা কখনোই নিরুপায় মানুষকে বাদ দিয়ে নয়। নিরুপায় মানুষের কথা পাওয়া যায় তাঁর গল্পে, যে গল্পে নৈঃশব্দই প্রধান। মূকাভিনয় গল্পটির কথা মনে করি। মহারাষ্ট্রের গণেশ মানকড়ের একটি নাটকের দল আছে। তারা অভিনয় করে। কিন্তু তা মূকাভিনয়। প্রথম পুরুষে লেখা গল্প। কথক সেই মানকড়ের নাটকের দলে ছোট ছোট নাটক লেখে। মূকাভিনয় হয় সেই নাটকের। নাট্য অভিনয়ের পিছনে থাকে যে ধারাবিবরণ, তাও কথককে বলতে হয়। মানকড় ভালো বাংলা জানে না। কত আধুনিক এবং জটিল জীবন-ধর্মের কথা এই গল্প। কত নীরবতার গল্প। মূকাভিনয় এক প্রাচীন রোমান নাট্যশিল্প যা যে কোনো মানুষের কাছে অনায়াসে পৌঁছতে পারে। অভিনেতার অভিব্যক্তিই না বলা ভিতরের কথাকে যেন সমুখে নিয়ে আসে। মানকড়ের দল প্রচার নাটক করে গ্রামে গ্রামে গিয়ে। মূকাভিনয় করতে করতে তারা নিজেরাই যেন মূক হয়ে গেছে। স্বামী স্ত্রী নরেন্দ্র এবং রাধা, রাজেন্দ্র এবং পদ্মা…তাদের ভিতরেও যেন যোজন যোজন নীরবতা। এই গল্প শাসক এবং শাসিতের। কিংবা শোষক এবং শোষিতের। নীরবতা, মূক হয়ে থাকা মানুষের নীরব অভিব্যক্তি যে কত প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে তা নিয়েই এই কাহিনি। পড়ার পর নীরবতাই যেন গ্রাস করে পাঠককে।
আমি সেই ‘মুখগুলি’র কথা বলি। দিব্যেন্দুদার সব গল্পই যেন মুখগুলি। মূকাভিনেতাদের মুখ, কিশোরী মুন্নির মুখ (মুন্নির সঙ্গে কিছুক্ষণ), যার পা মাড়িয়ে দিয়েছিল অনিল, সেই শিশুটির মুখ(মাড়িয়ে যাওয়া)। মুখগুলি গল্পের মায়ের মুখ, মায়ের সন্তানদের মুখ। কোনো কোনো গল্প পাঠকের হৃদয়কে এমন ভাবে ছুঁয়ে যায় যে সে ভোলে না ভোলেনা কিছুতেই। আর দিব্যেন্দু পালিত যেন সময় থেকে সব সময়ই এগিয়ে ছিলেন কয়েক পা। মুখগুলি গল্প যখন বেরোয়, তখন ওল্ড এজ হোমের ধারণা তেমন স্বচ্ছ ছিল না আমাদের কাছে। সবে তা আসছে এই শহরে, শহরতলীতে। মা গেলেন ওল্ড এজ হোমে। বাবার মৃত্যুর পর মা তাঁর ছেলে মেয়েদের ভিতরে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন একটু একটু করে। ভাগ হয়ে কখনো বালিগঞ্জ, কখনো ভবানীপুর, কখনো বাগবাজার কখনো রিষড়ায় ঘুরে ঘুরে আশ্রয় পায়। কিন্তু তারপর ও মা হয়ে যাচ্ছিলেন ভার। মায়ের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাচ্ছিল যে তা টের পেয়েছিল তাঁর পুত্র কন্যারা। তাই গোল টেবিলে বিচার হয়ে গিয়েছিল মা সুধা ওল্ড এজ হোমে যাবেন। সুধা কোনো অনুযোগ করেন নি। গভীর রাতে দিবাকরের ঘুম ভেঙে গিয়েছিল, সে মায়ের ঘরের দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়ে দেখেছিল, স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি কুঁকড়ে শুয়ে আছে মা। মিলিত সিদ্ধান্তে মা সকাল হলে চলে যাবে। মা গিয়েছিল। মাকে সেখানে রেখে দিয়ে আসতে পেরে সবাই নিশ্চিন্ত। দিবাকর মাকে কিছু খাম পোস্ট কার্ড আর ড্রাইভারের কাছ থেকে চেয়ে তার সস্তার ডট পেনটি দিয়ে এসেছিল। সুধা চিঠি লিখবে। সুধার চিঠি আসে। সেই চিঠির কথা দিয়েই গল্প আরম্ভ। পরম কল্যাণীয় স্নেহের বাবা দিবাকর…, মা সকলের কুশল জানতে চেয়েছে, নাতি নাতনি, বৌমা। মা খবর দিয়েছে হোমের কৌশল্যাদি নামের একজন মারা গেছে। তাঁর ছেলে থাকে বিলেতে, মেয়ে বাচ্চা হবার জন্য হাসপাতালে। কেউ আসেনি। হোমের ওরাই তাকে কালো গাড়ি করে শ্মশানে নিয়ে গেছে। মা খবর দিয়েছে, রানি পরমেশ, মেয়ে জামাই, তাকে দেখতে এসেছিল। কমলালেবু আর আপেল এনেছিল। ছোট ছেলে ভাস্কর এসেছিল মাকে দেখতে। মায়ের ওল্ড এজ হোমে আর এক কন্যার চিঠি এসেছে। মা সেখানে বসেই বড়ছেলে দিবাকরকে অনুনয় করে, ছোটছেলে ভাস্করকে একটা ভাল চাকরি জুটিয়ে দেওয়ার জন্য। মায়ের চিঠি পড়েই ধরা যায় মা ভাল আছে। হোমে সকলেই গিয়ে যোগাযোগ রাখছে মায়ের সঙ্গে আগের চেয়ে বেশিই। দিবাকর গিয়েছিল হোমে মাকে দেখতে। সারি সারি বেতের চেয়ারে বসে আছেন যাঁরা বেশিরভাগই বৃদ্ধা। বৃদ্ধও আছেন দু-একজনা। তাদের একজনকে মা বলে ভুল করেছিল দিবাকর। পরে ভুল ভাঙল। মায়ের ভিজিটর হয়ে সে বসেছিল ভিজিটরস্ রুমে। মায়ের সঙ্গে তার যে তেমন কোনো কথা ছিল না তা টের পেয়েছিল দিবাকর। মা বলেছিল, ‘খুব ভাল আছি আমি, আমার জন্য ভাবিস নে।’