স্বাধীনতা তুমি
রবিঠাকুরের অজর কবিতা, অবিনাশী গান।
স্বাধীনতা তুমি
কাজী নজরুল, ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো
মহান পুরুষ, সৃষ্টি সুখের উল্লাসে কাঁপা – ( শামসুর রাহমান )
হে স্বাধীনতা তুমি
আমরা চলেছি স্বাধীন ভারতের পতাকা তুলতে অনেকটা দূরে। ধরলা নদী পেরিয়ে বাঁশুয়া খামার সেই মৌজার নাম। কোচবিহার জেলার দিনহাটা মহকুমার গীতালদহ সীমান্তে। ওদিকে বাংলাদেশের লালমনিরহাট জেলা। আর আছে ঠিক সীমান্তে ওপারে সেই মোগলহাট। ধরলা নদীর ওপারে মোগলহাটের কথা আমি অনেক শুনেছি। ঐ হাট বসিয়েছিল এক মোগল ফৌজদার। মোগল ফৌজদার কোচবিহার জয় করতে আসছিল রংপুর থেকে। ধরলা নদীর ধারে, ওপারে তাঁবু ফেলে কদিন বিশ্রাম। খোঁজ খবর আসছে স্বাধীন রাজ্য কোচবিহার থেকে। রাজার দত্তক পুত্র দীননারায়ণ সিংহাসনের লোভে মোগল ফৌজদারকে ডেকে এনেছিল এই রাজ্যে। একটি বছর কোচবিহার ছিল মোগলের অধীন। ফৌজদার সিংহাসনে বসিয়েছিল দীননারায়ণকে। এ হলো অষ্টাদশ শতকের তিরিশের দশকের কথা। এক বছর পর কোচবিহারের রাজা ভুটানের রাজার সাহায্যে আবার জয় করে নেন নিজ রাজ্য। এ হলো ইতিহাসের কথা। কিছু সত্য। কিছু কল্পনা। হয়তো অনেক সত্যই হারিয়ে গেছে, কিন্তু কিছু কিছু চিহ্ন নিয়ে সেই সময় টিকে আছে। মোগলহাট সেই চিহ্ন। আমরা মোগলহাটে যেতে পারব না, সেই হাট বাংলাদেশ। বাংলাদেশ আমার দেশ নয়। কিন্তু আমার পিতৃপুরুষের দেশ। স্বজন বন্ধুদের দেশ। ভারত আমার দেশ। আমার ও আমার সন্তানদের দেশ। আমরা চলেছি এক নতুন ভূখন্ডকে স্বাধীন ভারতের অংশ ঘোষণা করতে। গত রাতে ঠিক বারোটার সময় আকাশে ছিল পরিপূর্ণ চাঁদ, মেঘের ভিতর থেকে তা মুখ বাড়িয়েছিল মধ্য মশালডাঙা মৌজায় স্বাধীন ভারতের পতাকা উত্তোলন দেখতে। রাত বারোটার সেই কেন্দ্রীয় অনুষ্ঠান ছিল ছিটমহল বিনিময় সমিতির। অনেক ফানুস উড়েছিল, অনেক আলোর ঝলকানি দেখেছিলাম, দেখেছিলাম কত উল্লসিত মুখ, ছিটমহলের বাসিন্দারা পেল নিজ দেশ নিজ দেশের ভিতরেই। গ্রামগুলির অদ্ভুত এক অলীক এক পরিচয় ছিল, দেশের ভিতরে বিদেশ। ভারতের ভিতরে বাংলাদেশ। তারা আজ ১লা আগস্ট থেকে হয়ে গেল ভারতের ভিতরে ভারত। গত ৬ই জুন ২০১৫ দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায় বসে যে স্থলসীমা চুক্তি করেছেন, তাতেই এই ঘোষণা ছিল। প্রশাসন ১লা আগস্ট সকাল নটায় ভারতের একান্ন ছিটমহলেই ভারতের পতাকা উত্তোলন করে সেই স্বাধীনতায় শিলমোহর দেবেন। আমরা, আমি, তরুণ বন্ধু সাংবাদিক অনমিত্র চট্টোপাধ্যায় প্রশাসনের সঙ্গী হলাম। ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট শীতল বসু বললেন, ৫১ ছিটের ভিতরে দিনহাটা মহকুমায় আছে ১৯টি ছিট-মৌজা।
ছিটমহল বিনিময় সম্পূর্ণতা পাবে সেখানে প্রশাসন ভারতের পতাকা উত্তোলন করলে। প্রশাসনিক স্বীকৃতি ছিল না বলেই তো ছিটমহলের একান্ন গ্রাম ছিল রাষ্ট্রহীন। আর রাষ্ট্রহীন হওয়ার যে ভয়ানক অপমান, লাঞ্ছনা ছিটমহলের মানুষ ১৯৪৭ থেকে এই ২০১৫ পযর্ন্ত ভোগ করেছে তা অবর্ণনীয়। আসলে সে ছিল বন্দী দশা। ভারতের ভিতরের ভূখণ্ড, কিন্তু তা আগে পাকিস্তান পরে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের সঙ্গে ছিটমহলগুলির যোগাযোগ নেই বছর তিরিশ আগে কাঁটাতারে সীমান্ত ঘিরে ফেলার পর থেকে। যদিও ধরলার ওপারে কাঁটাতার নেই। তাই বাঁশুয়া খামার মৌজাটি স্থলভূমিতে বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্ত ছিল, যদিও সেই বাংলাদেশে যেতে হলেও ভারতীয় গ্রাম দড়িবশ ও ঝালি ধরলা পার হতে হতো। এক দেশের ভিতর দিয়ে আর এক দেশে। শুনলাম সবর্ত্র এবার কাঁটাতার বসে যাবে। স্থলসীমা চুক্তির জন্যই অপেক্ষা করছিল প্রশাসন। ছিটমহলবাসীর বন্দীদশা এমনই ছিল, গ্রাম থেকে বেরিয়ে ভারতীয় ভূখন্ডে পা রাখলেই পুলিশ কিংবা সীমান্তরক্ষীদের হাতে গ্রেপ্তার হয়ে বাংলাদেশে পুশব্যাক, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো সবুদ ছিল না। আবার বাংলাদেশেও তারা অবাঞ্ছিত। আইনত বাংলাদেশী হলেও কোনো পরিচয়পত্র নেই। ভারতের ভিতরে বাস। সেই নেই রাজ্যের বাসিন্দারা এতদিনে পায়ের তলায় মাটি পেল। সেই মাটি এক দেশ পাবে রাষ্ট্রের প্রতিনিধি রাষ্ট্রের পতাকা তুললে।
১লা আগস্ট সকালে দিনহাটা থেকে রঙপুর রোড ধরে রওনা হলাম স্বাধীনতার পতাকা উত্তোলনে। স্বাধীনতা উদযাপনে। আমি তো ১৯৪৭-এর স্বাধীনতা দেখিনি। স্বাধীন দেশে জন্মেছি। স্বাধীন দেশে বড় হয়েছি। পরাধীনতা, বন্দীদশা ইত্যাদির সঙ্গে আমার কেন, আমরা যারা যাচ্ছি গীতালদহর দিকে বাঁশুয়া খামারের পথে, তাদের কোনো পরিচয় হয়নি এতটা জীবনে। আমিই বোধ হয় সিনিয়র ছিলাম সেই যাত্রা পথের সঙ্গীদের ভিতর। আমিও জানি না রাষ্ট্রহীনতা এক ব্যক্তি মানুষের জীবনে কতটা অভিশাপ হয়ে আসতে পারে। ছিটবাসী আপনি আপনার সন্তানটিকে পালস পোলিও খাওয়াবেন। সন্তানের মা সন্তান কোলে পালস পোলিও শিবিরে গেল। স্বামীর নাম, ঠিকানা? ছিটমহল হলে মাকে সন্তান নিয়ে ফিরে আসতে হবে। অগত্যা মূল ভূখন্ডের কোনো ব্যক্তির নাম ঠিকানা, স্বামীর নাম আর ঠিকানা হলো সেই মায়ের। সন্তানের পিতৃপরিচয় বদল করে তবে না পালস পোলিও খাওয়ানো। কত লজ্জা আর অসম্মান। ইস্কুলে ভর্তি হতে হলেও সেই পিতৃপরিচয় বদলীকরণ। ছিটমহল তো বিদেশ। মানুষের মৌলিক অধিকার ছিটমহলবাসীর ছিল না। আপনার ১৬-১৭ বছরের কন্যাকে যদি তুলে নিয়ে যাওয়ার হুমকি দেয় মাস্তান, কার কাছে যাবেন অভিযোগ নিয়ে? ছিটমহল যে বিদেশ, সেখানকার মানুষের অভিযোগ ভারতীয় থানা নেবে কেন? অথচ গ্রামগুলি ভারতের ভিতরেই। কত যে অপমান আর লাঞ্ছনা, তার ফিরিস্তি দিলে কাহিনি অনেক বড় হয়ে যাবে। বন্দীর যে অধিকার থাকে তাও ছিল না তাদের। আজ ১লা আগস্ট, আজ সমস্ত লাঞ্ছনার অবসান। আজ তাই আর পুরোন ক্ষতের কথা নাই বা তোলা হলো। গতকাল রাত বারোটার পর থেকে ছিটমহলের পরিচয় বদল হয়ে গেছে। কোচবিহার জেলার অভ্যন্তরের ৫১টি ছিটে ভারতের পতাকা উড়বে আজ।