শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে অনেকভাবে দেখা যায়। আমি এই মুহূর্তে তাঁকে এই ভাবে দেখছি। নিরুপায় জীবন, নিষ্ঠুর জীবন, ব্যাপ্ত জীবনকে প্রকৃতির ভিতর থেকে তুলে নিয়ে আসতেন তিনি। মনে পড়ে যাচ্ছে “সে” গল্পের বড় পিসের ছেলে মোহিনী দাদাকে, যে কিনা একা খুলনা পর্যন্ত সমস্ত রাত্রি হেঁটে চলে যেত নামগান করতে করতে। সে ছিল কথক ঠাকুর। দেশভাগের পর এপারে এসে ঘুমতে না পেরে গরুর দড়ি ধরে যাত্রা করেছিল পূর্ব বাংলার পথে। তারপর খরাদীর্ণ পুকুরপাড়ে গরুর সঙ্গে মরেছিল সেই কথক ঠাকুর। মনে পড়ে যাচ্ছে “সাক্ষী ডুমুর গাছ” নামের সেই তিক্ত জীবনের গল্পটিকে। শ্যামলবাবুর শিকড় ছিল মাটির অনেক গভীরে, মাথা ছিল আকাশে। ঠিক যেন সেই পুরনো তলগাছটির মতো। বিষয় আশয় তাঁর কম ছিল না। কুবের সাধুখাঁ তো তিনি নিজে। এই বিষয় আশয়ের স্বাদ আমাদের সাহিত্যে নতুন না হলেও, দেখাটা সম্পূর্ণ নতুন, দেখার ভঙ্গিও। এই নতুনত্বের সজীবতাই তার লেখা আলাদা করে দিয়েছিল সকলের থেকে, তা গল্প হোক, উপন্যাস হোক, বাজার সফরের মতো কেনাবেচার কথা হোক।
যে লেখক তার সমস্ত জীবন ধরে নিরুপায় প্রাণের কথা বলে গেছেন, তাঁর শেষ বছরটি বড় নিরুপায় হয়ে কেটেছিল। যেন বড় গাঙ-সমুদ্রে বিকল হয়ে ভাসা ভুটভুটিতে পচা ইলিশ নিয়ে হাজরা হালদার।
আচমকা আমার মনে হয় সেই পুরনো তেঁতুলগাছটিকে যেন বাণ মেরে দিয়েছিল প্রতিবেশী। পোড়ো গায়েনের নাতিপুতিদের কোনো শরিক। হতেই পারে, এমন বিশ্বাস নিয়েই তো পোড়ো গায়েনেরা বেঁচে থাকে। তাদের অগোচরে গাছটির গোড়ায় কেউ হয়ত ঢেলে দিয়েছিল বিষতেল। শেকড় শুকিয়ে গেল। শ্যামলবাবুকে দেখে তেমন মনে হতো। মানুষ বড় নিরুপায়। মানুষ সর্দি কাশির ঠিক ওষুধটা খুঁজে বের করতে পারেনি আর কিনা ক্লোনিং করে নতুন মানুষ তৈরি করতে যাচ্ছে। মানুষ বড় অসহায় তা যেমন শ্যামলবাবুর যে কোনো লেখা পড়লে টের পাওয়া যায়, তেমনি অনুভব করেছি ২০০০ সালের অক্টোবর থেকে ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে আমার দূর নক্ষত্রের মানুষ বলে মনে হয়। মনে হয় সিন্ধু সভ্যতার কেউ। পুরুষপুর, গান্ধারে বসে তিনি যেন নির্মাণ করেছিলেন সভ্যতার এক মহৎ পর্ব। তাঁর লেখার ভিতরে যে আদিমতা তাতে যেন ছায়ায় ঢেকে যাওয়া সেই পৃথিবীর মানুষ বলেই মনে হয় আমার। এ শুধুই মনে হওয়া। শুধুই কল্পনা করা। আর কিছুই নয় হয়ত। কিন্তু এও সত্য, তাঁর গল্প উপন্যাসের চরিত্রগুলি সময় থেকে সময়ান্তরে হেঁটে বেড়ায়। প্রগাঢ় ইতিহাসবোধ, ঐতিহ্যচেতনা শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে আর পাঁচজনের থেকে আলাদা করে দিয়েছে। “গঙ্গা একটি নদীর নাম” উপন্যাসে চাঁদ হোসিয়ারির মালিক চাঁদ মহম্মদের ছেলে তাজ মহম্মদ রূপনারায়ণের কূলে বসেই যেন জেগে ওঠে পাঁচশো বছর আগের পৃথিবীতে, তার সঙ্গে দেখা হয় মনসামঙ্গল কাব্যের লেখক কবি বিপ্রদাস পিপলাই, ওলন্দাজ সার্ভেয়র ফান ডেন ব্রেক, পর্তুগীজ সার্ভেয়র জ্যাও দ্য বারোজ-এর সঙ্গে। কেউই কোনো সময়ে থেমে নেই। বিপ্রদাস মনসামঙ্গল লেখেন ১৪৯৫-এ, তখন নবদ্বীপে নিমাই পণ্ডিতের বয়স মাত্র দশ। ফান ডেন ব্রেক এদেশে আসেন ১৬৩০-এ, আর জ্যাও দ্য বারোজ ১৫৫০-এ, সবাই বঙ্কিমচন্দ্রের ভাষায় কথা বলে তাজ মহম্মদের সঙ্গে। তারপর তিন সময়ের তিন মানুষ তর্কে বসে আদি সপ্তগ্রাম, সরস্বতী নদীর প্রবাহ, ফাহিয়েনের বিবরণ-আমাদের নদ-নদীর ইতিহাস নিয়ে। সে এক আশ্চর্য লিখন। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে তাহলে সিন্ধুতীরে হেঁটে যেতে দেখবে না কেন তাঁর এই মুগ্ধ পাঠক। তিনিই যেতে পারতেন একই সঙ্গে ১৪৯৫, ১৫৫০, ১৬৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে খ্রিস্টপূর্ব দু’হাজার বছর আগের, তারও আগের পৃথিবীতে। গেছেনও সেই পথে হয়ত।
আগুন সব পোড়াতে পারে না
ছ’মাস হয়ে গেল। গত ৩রা জানুয়ারি অপরাহ্ন বেলায়, সূর্যাস্তের সময়, সূর্যাস্তের শীতার্ত পথে হাসপাতালের হিমঘরে যখন দিব্যেন্দুদাকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, আমি মনে করতে চাইছি তাঁর সেই গল্পের কথা। মা আছেন বৃদ্ধাশ্রমে। মায়ের সন্তানরা নানা জায়গায় ছড়িয়ে। সকলেই কৃতী। কী বেদনায় আবিষ্ট করেছিল সেই গল্প। এখনো ভাবলে মন খারাপ হয়ে যায়। আমাদেরও বয়স হচ্ছে যে। মনে করতেই পারলাম না নামটি। হিমঘরে ঢুকে গেলেন তিনি, নামটি বলে গেলেন, ‘মুখগুলি’। কত মানুষের মুখ তাঁর লেখায়। নিঃশব্দে চেয়ে আছে সকলে। মূকাভিনয়ের চরিত্ররা যেন।
ভাগলপুরের সদ্য কৈশোর অতিক্রান্ত যুবক ১৬ বছর বয়সে ছন্দপতন নামে একটি গল্প পাঠিয়েছিলেন কলকাতার প্রধান সংবাদপত্রের রবিবাসরীয়র জন্য। সেই গল্প ছাপা হয়েছিল। ভাগলপুর বহু কৃতি ও শ্রেষ্ঠ মানুষের জন্ম দিয়েছে একসময়। উত্তর বিহারের পূর্ণিয়া, ভাগলপুর এবং দ্বারভাঙা ছিল কৃতি বাঙালির উপনিবেশ। তপন সিংহ, সুমিত্রা দেবী, ছায়া দেবী, কিশোরকুমারদের বিখ্যাত গাঙ্গুলি পরিবার ভাগল- পুরের। বনফুল বাস করতেন ভাগলপুরে। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় ভাগলপুরেই গঙ্গাতীরে বড়বাসায় একটি বাড়িতে থাকতেন। তখন তিনি কলকাতার খেলাৎ ঘোষদের জমিদারির নায়েব। জমি বন্দোবস্ত দিতেই তাঁর ওখানে থাকা। শুনেছি পথের পাঁচালী লেখা হয়েছিল ভাগলপুরে বসেই। বড়বাসা। শরৎচন্দ্রের মামা বাড়ি ভাগলপুরে। শ্রীকান্ত উপন্যাস আরম্ভ হয় ভাগলপুরের গঙ্গায়। গঙ্গার উত্তাল স্রোতে ইন্দ্রনাথ বটের ঝুরি ধরে নেমে যাচ্ছিল। বিচিত্রা পত্রিকার উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায়ের বাড়ি ছিল ভাগলপুরেই। দ্বারভাঙায় থাকতেন বিভূতিভূষণ মুখোপাধ্যায়। পূর্ণিয়ায় সতীনাথ ভাদুড়ী। দিব্যেন্দু পালিত সাহিত্যের সেই পরিমণ্ডল থেকেই কলকাতায় এসেছিলেন লিখবেন বলে। অনিশ্চিত যাত্রা বলতে পারি। লেখক হতে এসে কতজন পারে সিদ্ধিতে পৌঁছতে? লেখক তো কেউ একদিনে হয় না। সমস্ত জীবন তাঁকে অপেক্ষা করতে হয়। দিব্যেন্দুদা পেরেছিলেন। বাংলা সাহিত্যে তিনি যে আলো আর ছায়া রেখে গেছেন তা থাকবে। নিশ্চিত থাকবে। নগর মননের এমন লেখক আমাদের সাহিত্যে দুর্লভ। তিনি নৈঃশব্দের কথাকার। গল্প বলি উপন্যাস বলি, নৈঃশব্দই যেন তার প্রধান উপাদান। কী আশ্চর্য পরিমিতি বোধ ছিল তাঁর। সেই সব কথা বলব। বলি সেই যুবকের কলকাতায় আসার কথা। পড়বেন। লিখবেন। কলকাতায় এলে হয়তো লেখার সুবিধে হবে। বাবা মারা গেছেন। দাদা একা চাকুরে। সমস্ত সংসারের ভার তাঁর উপর। তাঁরও একটি জীবিকার দরকার। দিব্যেন্দুদার কাছেই সব শোনা। শোনা সেই কঠিন দিনগুলির কথা। নিরাশ্রয় হয়ে কিছুদিন শিয়ালদা স্টেশনেও তাঁকে থাকতে হয়েছিল। সারাদিন খাওয়া হয়নি, শিয়ালদা স্টেশনে উদ্বাস্তুদের ভিড়। শিয়ালদা নর্থের টিকিট কাউন্টারের সামনে একটা খুব মোটা পুরু বেঞ্চি পাতা থাকত। সেইটাই ছিল আমার রাত্রে শোয়ার জায়গা। সেখানে রাতে শুতেন, কিন্তু খেতে পেতেন না। একদিন খাবার জোটেনি। খিদের জ্বালায় হাঁটুতে মুখ গুঁজে কাঁদছিলেন দেখে এক উদ্বাস্তু বৃদ্ধা তাঁর কাছে এসে শালপাতায় তিনটে রুটি আর তরকারি দিয়ে বলেছিলেন, ‘দেখে তো মনে হচ্ছে ভদ্রলোকের ছেলে। খাওয়া হয়নি। তুমি এটা খাও বাবা।’ সেদিন তিনি সেই যুবককে অনাহার থেকে বাঁচিয়েছিলেন। এসব কথা আমি ভাবছিলাম মেঘমল্লারের নিচে শায়িত দিব্যেন্দু পালিতের সমুখে বসে। অনাহার, অন্ধ হয়ে যেতে যেতে বুদ্ধদেব বসুর স্নেহে চোখের আলো ফিরে পাওয়া, সবই ঘটেছিল সেই নিঃশব্দ যুদ্ধের দিনগুলিতে। এসব আমি শুনেছি তাঁর মুখে। তাঁর জীবন গেছে নির্মম সত্যকে স্পর্শ করতে করতে। তিনি আদ্যন্ত নাগরিক মননের লেখক। আর তিনি মধ্যবিত্তকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারেন এমন এক আয়নার সামনে যে আয়নায় সে তার অন্তরাত্মা দেখে মুখ নিচু করে থাকে। তাঁর কন্ঠস্বর উঁচু নয়। নিম্নস্বরে কথা বলা তার গল্প থেকে শেখা যায়। যিনি দেখেছেন অনেক তাঁকে উঁচু গলায় কথা বলতে হয় না। অনুচ্চ কন্ঠস্বর যে কত তীব্র হতে পারে, মিতভাষণ যে কত কঠিন সত্যকে উচ্চারণ করতে পারে, তা দিব্যেন্দু পালিতের গল্প আর উপন্যাস পড়লে শেখা যায়। নগর সভ্যতা মানুষের মনের যে জটিলতা যে অসহায়তা যে নিরূপায়তাকে ধারণ করে তা দিব্যেন্দু পালিতের গল্প আর উপন্যাসে রয়ে গেছে। সহযোদ্ধা, আমরা, অনুভব, ঘরবাড়ি, সোনালী জীবন, ঢেউ, বৃষ্টির ঘ্রাণের মতো উপন্যাস ও জেটল্যাগ, গাভাসকার, হিন্দু, জাতীয় পতাকা, ত্রাতা, মুন্নির সঙ্গে কিছুক্ষণ, মাড়িয়ে যাওয়া, ব্রাজিল, আলমের নিজের বাড়ি, মূকাভিনয়, মাইন নদীর জল, মুখগুলি, গাঢ় নিরুদ্দেশে-গল্পের পর গল্পের কথা মনে পড়ে। আপাদ মস্তক এক রুচিশীল স্নেহময় মানুষ, যত না লিখতেন, পড়তেন অনেক বেশি। সহযোদ্ধা উপন্যাসের কথা মনে পড়ে। সেই যে ঘটনা ঘটেছিল সত্তর দশকের এক কালো সময়ে, একটি হত্যাকাণ্ড দেখে মানুষটি চুপ করে থাকতে পারল না, বিবেক তাকে সত্যভাষণে প্ররোচিত করল। পুলিশের জেরা, পুলিশি আতঙ্ক, তার নিজের উপর আস্থা নষ্ট করতে পারেনি, যা চোখে দেখেছে সে, তা অবিশ্বাস করবে কী করে? তার সাজানো জীবন নষ্ট হয়ে গেল। পুলিশ তাকে নিজের হেফাজতে নিল। হত্যাকাণ্ডে যে পুলিশই জড়িয়ে ছিল। সহযোদ্ধা উপন্যাসের একটি বাস্তবতা আমরা জানি। সাংবাদিক বিপ্লবী সরোজ দত্তের অন্তর্ধানেই লুকিয়ে ছিল সহযোদ্ধার সত্য, সেই ভয়ানক নিরুদ্দেশের কথা কীভাবে উপন্যাসে শিল্পিত ভাবে লিখে রাখা যায়, তা তিনিই দেখিয়েছিলেন। এমন উপন্যাস লিখে তিনি তাঁর দায় পালন করেছিলেন যেন। আর একটি উপন্যাসের কথাও মনে পড়ে, অন্তর্ধান। তপন সিংহ ছবি করেছিলেন। তারও এক বাস্তবতা ছিল এক কিশোরীর অপহরণ এবং তাকে খুঁজতে খুঁজতে তার বাবার অদ্ভুত মৃত্যু, ঘটমান বাস্তবতা এবং শিল্পের বাস্তবতাকে আমরা একসঙ্গে ছুঁয়ে থেকেছিলাম। নিশ্চুপ মৃদুভাষী মানুষ, কিন্তু ভিতরে যে কতটা আগুন ছিল, কোলাহল ছিল তা ‘সহযোদ্ধা’ পড়লে ধরা যায়। ‘অন্তর্ধান’ উপন্যাসে বোঝা যায়।