“রাখাল কড়াই” গল্পের ক্ষীরোদ ভয় পেয়ে বাদার ধানক্ষেত ধরে পালিয়ে যাচ্ছিল গরাণবেড়ে থেকে! গরাণবেড়ের বুড়োদের কথা তার সত্য মনে হয়েছিল। ফেরার পথে সে দ্যাখে বিদ্যাধরীর মরা সোঁতায় জল আছে। মরা বিদ্যাধরীকে সে বেঁচে উঠতে দ্যাখে যেন। তা কি আর সত্যি হতে পারে? কিন্তু ভীত ক্ষীরোদ পাকড়াশির মনের ভিতরে তেমন এক সম্ভাবনা তৈরি হয়ে যায়। পোড়ো গায়েন ফিরতে পারে এমন অসম্ভবের ইঙ্গিতে কাহিনি অনিঃশেষ হয়ে যায়। এই অনিঃশেষতা শ্যামলবাবুর গল্প, উপন্যাসে দিয়েছে বহুমাত্রা। “দশ লক্ষ বছর আগে” নামের ক্ষুদ্র আখ্যানটিতেও।
আমি আর একটি গল্পের কথা বলছি। “সে” নামের গল্পটি দু’হাজার সালে লেখেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। তাঁর কোনো লেখাই আগের লেখার মতো নয়। যে অনিঃশেষতা তার আশ্চর্য উপন্যাস— কুবেরের বিষয় আশয়, ঈশ্বরীতলার রূপোকথা, চন্দনেশ্বর জংশন, স্বর্গের আগের স্টেশন বা রাখাল কড়াই, চন্দনেশ্বরের মাচানতলায়, হাজরা নস্করের যাত্রাসঙ্গী, দখল, পরী ইত্যাদি গল্পগুলিকে কিংবদন্তীর মতো করে গড়ে তুলেছে আমাদের পাঠ অভিজ্ঞতায়, সেই অনিঃশেষতাও শেষ কথা নয়। শ্যামল বাবু তাকেও ভেঙে দিতে পারেন। “সে” গল্পের বড় পিসেমশাইটির জন্ম ১৮৪৩-এ। তাঁর চোদ্দবছর বয়সে সিপাহী বিদ্রোহ। সেই মানুষটি ছিলেন প্রবল শক্তিমান। ওপার বাংলার বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী মোরেলগঞ্জ নিবাসী বড় পিসেমশাই এখনো কাহিনি কথকের পরিবারে কিংবদন্তীর মত বেঁচে আছেন। তাঁর বড়ছেলে মোহিনীদা এক রাতে পাড়ি দিতেন তিরিশ মাইলের উপর, স্রেফ পায়ে হেঁটে, কথকতা করে বেড়াতেন। বেঁচে থাকলে বড় পিসেমশাই-এর বয়স হতো ১৫৭ বছর। এখন তিনি কোথায়? এই গল্পের কাহিনিকথক, ধরা যাক তিনি শ্যামলবাবুই, ১৫৭ বছর বয়সী পিসেমশাইকে এই শহরে পেয়ে যেতে থাকেন। লোকটা তাঁকে বারবার যেন বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে থাকে। এর নাম কি যাদু বাস্তবতা? কল্পনার এই সীমাহীনতা তো শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় পাঠে বারবার প্রলুব্ধ করে। বারবার বিপদে কাহিনিকথকের পিছনে এসে দাঁড়ান যেন মোরেলগঞ্জের বড় পিসে, শ্যামলবাবু দেখতে পান মর্তমান কলার সাইজের পায়ের আঙুল, বুড়ো কাতলা মাছের আঁশের মতো নখ। এক এক সময়ে তার এক একরকম ছদ্মবেশ। বাসের ভিতরে ছাইরঙের ভেলভেট স্যু পায়ে ঢ্যাঙা একটি মানুষ, গায়ে তার স্পোর্টস গেঞ্জি, পরনে রিংকল-ফ্রি প্যান্টুলুন। মধ্যবয়সী যুবক, বছর ৪০-৪৫ হয়ত হতে পারে। তার কি ১৫৭ বছর হবে? শ্যামলবাবু ভাবতে থাকেন। হতে পারে হয়তো। বাইরেটা আগাগোড়াই ছদ্মবেশ কি হতে পারে না? তো সেই লোকই কন্ডাক্টরের হাত থেকে টিকিটের টাকা বাঁচিয়ে দেয়-কাহিনিকথক টিকিট কাটেন না বাসে, তার অফিসে ক্লোজার, পি.এফ, গ্রাচুইটি কোনো টাকাই তিনি পাননি—একদল লোক ভাল দল পাকাতে পারে বলে তাদের জন্য গত বিশ বছরে দফায় দফায় মাইনে বাড়িয়ে আট হাজার কোটি টাকার বোঝা সাধারণ মানুষের ঘাড়ে চাপিয়ে দিয়েছে সরকার–বেশির ভাগ মানুষ ঘাড় নিচু করে আছে, ট্রেনে লজেন্স ফেরি করছে, বর্ডারে নুন পাচার করতে গিয়ে বি.এস এর হাতে চাঁদমারি হয়ে যাচ্ছে— কেন কাটবেন তিনি টিকিট? দু-আনার টিকিট দু’টাকায়। বড় পিসে তার পিছনে পিছনে আছেন। মেট্রো রেলের দরজা চলন্ত অবস্থায় খুলে গেলে মৃত্যু যখন অবধারিত বড় পিসে তাকে বাঁচান। তখন তাঁর ছদ্মবেশ ছিল আগের কালের জমিদারের মতো, ধুতি, পাঞ্জাবি, টিকোলো নাকের নীচে ঢেউ তোলা গোফ। তারপর ক্লান্ত শ্যামলবাবুকে বউবাজারে পিচ্ছিল রাস্তায় উঠতে হয় এক রিকশায়। রিকশাওয়ালা তাঁকে যেন বাঁচাল। তার আর সন্দেহ থাকে না রিকশাওয়ালাই বড় পিসে। এই ফ্যান্টাসি চলতে থাকে। বড় পিসে খারাপ মেয়ের হাত থেকে বাঁচাতে লোডশেডিং করে দেন, শেষ অবধি আশ্চর্য কিংবদন্তী ভেঙেচুরে যায় যখন পথের কচুরি বেচা, ভুট্টা বেচা দরিদ্র স্ত্রীলোকদের বাঁচাতে তিনি থানায় যান। বড় পিসে সঙ্গে আছে ভয় কী? তিনি গিয়ে পড়েন যার হাতে টাইগার নামের সেই আসামী পেটানো ডাণ্ডাবাজ লোকটির মস্ত চেহারা দেখে, পায়ের নখ দেখে, আঙুল দেখে তিনিই যে বড় পিসে সে বিষয়ে আর কোনো সন্দেহই থাকে না। সেই টাইগার তাকে প্রহার করতে আরম্ভ করে। যাবতীয় কল্পনা, বিভ্রম চূর্ণ হয়ে যেতে থাকে যখন বড় পিসের মত মানুষটি তাঁর উপর নির্দয় অত্যাচার আরম্ভ করে। রীতিমতো পুলিশি অত্যাচার নেমে আসে পুলিশের অনৈতিক এবং নিষ্ঠুর আচরণের প্রতিবাদ করতে যাওয়ায়। লেখক যে কল্পনা, বিভ্রমের মায়াবী আলোয় ঢেকে দিয়েছিলেন দেড়শো বছরের পুরনো বড় পিসেকে, তা নিজেই শেষ করে দেন। যাদুকর যাদু শেষ করে দাঁড়াল যে শূন্য মঞ্চে। নিরুপায় মানুষের কথা কত রকম ভাবে বলা যায়। এ-ও এক ধরণ। শ্যামলবাবুর নিজস্ব ধরণ।
শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়ের গল্প, উপন্যাসে বাস্তবতা বিভ্রম, কল্পনা পাশাপাশি থেকে মিলে মিশে গেছে। কোনটা বাস্তব কোনটা মায়া তা যেন ধরাই যায় না। আবার কল্পনা, মায়া, বিভ্রমই মূল বাস্তবতা হয়ে দাঁড়ায়। এক নিরুপায় প্রাণকে নানাভাবে দেখে নেওয়ার প্রবণতা তাঁর সব লেখায়। তা “সে” নামের গল্পটিতে যেমন তেমনি শাহজাদা দারাশুকোর মতো ভারত ইতিহাসের সেই আশ্চর্য মানুষটির হৃদয় উন্মোচনেও। আবার শ্যামলবাবুর নিরুপায় প্রাণ যে শুধু মানুষ তাই বা বলি কী করে? বাঘডাঁশাটি কি নিরুপায় নয়? সে অন্ধকার হলে গোপনে বেরিয়ে আসে গর্ত থেকে। “সে” গল্পের কথা তো বললামই। ওই নিরুপায় মানুষটি তো বেঁচে থাকার নানা কৌশল খুঁজে বের করতে করতে বাঁচে। শেষ পর্যন্ত বাঁচতে কী আর পারে? রাখাল কড়াই-এর পোড়ো গায়েনের নাতিপুতিরা বুড়ো তেঁতুলগাছ নিয়ে বাঁচে। হাজরা নস্কর গরুর সঙ্গে খাবার ভাগ করে বাঁচে। পচা ইলিশ ফেলে দিতে দিতে গাঙের ভিতরে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে চায় হাজরা হালদার। আবার বাঁচতে পারেনাও কেউ কেউ। ঈশ্বরীতলার হুলোবেড়াল, পাতিহাঁস, গাঙের ইলিশ। আর বালির ঝড়ে দশ লক্ষ বছর আগে বিলুপ্ত হওয়া অতিকায় ডায়নোসর। কিন্তু সেই অতিকায় প্রাণী আবার তার জীবন কণিকা রেখে যায় আর এক প্রাণে, তা বহন করে যায় নানা প্রাণী, বাঘডাঁশাও বহন করে উত্তরাধিকার সূত্রেই হয়ত।