কুবের সাধুখাঁর ভিতরে খাদক হয়ে ওঠার লোভ যেন জন্ম নিতে থাকে। কিন্তু তার এই জগতকে দেখা তো শুধুই দেখা নয়। তার দুচোখে ক্লান্তিহীন বিস্ময়। সেই বিস্ময় বোধই এই আখ্যানটিকে গভীর জীবনবোধের কাছে নিয়ে যায়। কুবের সাধুখাঁ সামান্য মানুষ, দু চার পয়সা আয় করাই তার কাছে ছিল সমস্যা। নিম্নমধ্যবিত্তের ভাঙাচোরা জীবন ছিল যার সম্বল, মনের ভিতরে এক পাপবোধকে নিরন্তর লালিত করে থাকে যে কুবের সাধুখাঁ, সেই অতি সাধারণ কুবের নিজভূমি ত্যাগ করে নেমে পড়ল জমি কেনাবেচার কারবারে। নিজের চারপাশের গণ্ডি মাড়িয়ে বাইরের বিপুলা পৃথিবীর ভিতরে নেমে এল যেন কুবের। জমি থেকে টাকা হয়। টাকা থেকে আরো জমি। নেশা আর লোভ বাড়ে। চাষবাসে নেমে পড়ল সে মেদনমল্লর চরে গিয়ে। চাষবাস ফসল থেকে সে চকদার, গাঁতিদার হয়ে উঠতে লাগল যেন, জমির পরিমাণ, দখল নিয়ে যে স্বত্ব, স্ট্যাটাস। দখল করল পরস্ত্রী। আর কী বাকি থাকে তার? প্রকৃতির মতো সীমাহীন হয়ে ওঠে যেন তার আকাঙ্ক্ষা। কদমপুরে নগর বসাতে চায়, মেদন মল্লর চরে বড় ফসল ফলিয়ে, চাষা খাটানো চকদার। বাঙালী মধ্যবিত্তের জীবনের ঘেরাটোপ থেকে কুবের যেমন বেরিয়ে পড়েছিল মেদনমল্লর চরে, তেমনি বাংলা উপন্যাসও নতুন পথে যাত্রা করেছিল যেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে।
“কুবেরের বিষয় আশয়” উপন্যাসে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় তার প্রকৃতি মগ্নতায় মুগ্ধ করেন। মেদনমল্লর চরে পড়ে থাকা ভাঙা দুর্গ, সরেস কুমারী মৃত্তিকা, চাষবাস, নদীনালা, নদী সরে যাওয়ায় জেগে ওঠা পয়স্থি জমি, চরভরাটি জমি, নদী ভরাটি জমি মিলিয়ে যে অনিঃশেষ প্রকৃতিকে লিখে ফেলেন, সেই প্রকৃতিতে এই তো মরতে মরতে টিকে আছে অদ্ভুত প্রাণী বাঘডাঁশাটি। তাকে যেন কুবেরের বিষয় আশয়-এর ভিতরেই অনুভব করা যায় অন্যভাবে। আমি বলতে চাইছি, ‘দশলক্ষ বছর আগে’ আখ্যানের বীজ যেন কুবের সাধুখাঁ, অনাথবন্ধু বসু (ঈশ্বরীতলার রূপোকথা) বা রাখাল কড়াই গল্পের ক্ষীরোদের কাছ থেকে সংগ্রহ করে রাখা।
রাখাল কড়াই গল্পে কাঠের কারবারি ক্ষীরোদ চলে বিদ্যাধরীর বাদা মাড়িয়ে গরাণবেড়েতে গাছ কিনতে। সেই গাছ কত বড়, না চার মানুষেও তার বেড় পায়না। সে এক জঙ্গুলে, বুনো তেঁতুল গাছ যার বয়সের গাছপাথর নেই। তিনখানা বড় করাত ভাড়া করে ক্ষীরোদ সেই গাছ একদিন কেটে নেবে। ঠিক করেছে গরাণবেড়ের লোকজন লাগিয়ে তিনদিনে কুড়োলে কুড়োলে কেটে পুরো গাছটা খান কয়েক গোরুর গাড়িতে চাপিয়ে নিয়ে চলে আসবে। যেতে যেতে ধানক্ষেতের ভিতরে বিদ্যাধরী নদীর কথা শোনে ক্ষীরোদ। তিনমাইল চওড়া নদী এখন ধানক্ষেত। ক্ষীরোদ পৌঁছয় গরাণ বেড়ে। ধান ক্ষেতের ভিতর দিয়েই সেই বিপুল বৃক্ষকে প্রত্যক্ষ করে। এক একখানা ডালে শেয়ালদার আধখানা প্লাটফর্ম যেন জুড়ে যাবে। তো গাঁয়ের মানুষ সেই গাছ না দেওয়ার কত ছলই না করে। তেঁতুল গাছের শরিক বুড়ো বলে, তাদের খুড়ো মশায়ের বাপের লেজ ছিল। তিনি নাকি এগাছ থেকে ওগাছে লাফাতে পারতেন। পাকা বাড়ির মেঝেয় চড় মেরে দাওয়া ফাটিয়ে দিতেন। তিনি মরেননি। শেষ বয়সে নাকি একা একাই করাতি নদী পার হয়ে সুন্দরবনের দিকে হেঁটে চলে গেছেন-আর ফেরেননি। তা ঐ তেঁতুল গাছে তাঁর চিতার জন্য একটা ডাল রাখা আছে। তিনি মরলেই তো লাশ চিতায় দিতে হবে। তাঁর নাম পোড়ো গায়েন। তিনি যে তালডোঙায় চেপে চলে গিয়েছিলেন সুন্দরবনের গভীরে, সেই তালডোঙায় চেপেই ফিরবেন। ফিরবেন বটে, কিন্তু নদী তো মরে গেছে। করাতি, বিদ্যাধরী শুকিয়ে কাঠ। আড়াইশো বছরের বুড়ো পোড়ো গায়েন তো আর হেঁটে ফিরতে পারবে না।
কিন্তু পোড়ো গায়েন ফিরবেই। তাকে ফেরাবে বলেই না তেঁতুল গাছে তার চিতার কাঠটি সংরক্ষিত রেখে তার নাতিপুতি বুড়োরা বসে আছে। পোড়ো গায়েনের ফেরা না ফেরা নিয়ে যখন কথা চলতে থাকে তখনই গাছের উপর থেকে নেমে এল কালো একটি সরীসৃপ, খড়িচোঁচ।
তেঁতুল গাছটিকে রেখে দেওয়ার জন্য, কাঠের কারবারি ক্ষীরোদ পাকড়াশিকে ফেরত পাঠানোর জন্য কোনো এক পোড়ো গায়েনের নাতিপুতিদের কতই না ছল। ছল করেই না পোড়ো গায়েনের কথাটা তৈরি করা। আবার তৈরিই বা কী করে বলি? এমন কিংবদন্তী তো অতবড় গাছকে ঘিরে গড়ে উঠতেই পারে। এ হয়ত গরাণবেড়ের মানুষের বিশ্বাস। বিশ্বাস-অবিশ্বাস, হ্যাঁ-নার ভিতরের সমস্ত সীমারেখাকে তছনছ করে দিতে পারেন শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়। পড়তে পড়তে মনে হয় তালডোঙায় করে সেই আড়াইশো বছর আগে সুন্দরবনের গভীরে ভেসে যাওয়া পোড়ো গায়েন কি আত্মগোপন করে নিজেকে রক্ষা করেছিল? যার লেজ ছিল, যে কিনা এ গাছ থেকে সে গাছে লাফাতে পারত। সেই পোড়ো গায়েনের লুকিয়ে পড়া ছাড়া আর তো কোনো উপায় ছিল না বাঁচার। সংহতি কলোনির পুরনো পুকুরের গায়ের গর্তে যে বাঘডাঁশাটি নিজেকে বাঁচিয়ে রেখেছে, সেই কি তাহলে পোড়ো গায়েন? প্রাণ তো এই ভাবেই থেকে যায় অন্য প্রাণের ভিতরে। এক একটা সময়ে পৃথিবীতে এক এক প্রাণের ঢেউ এসেছে, তা নিঃশেষও হয়েছে, ডায়নোসররা বিলুপ্ত হয়েছিল হয়ত বালির ঝড়ে-প্রকৃতির সঙ্গে যুঝতে না পেরে-কিন্তু তার ছায়া তো বাঘডাঁশার ভিতরে গভীর রাত্রিতে প্রত্যক্ষ করে এলসা টিচবোর্ন(কুণ্ডু)। পোড়ো গায়েনকে আমি যেন দেখতে পাই সেই বাঘডাঁশার ভিতরে। এলসা টিচবোর্নের দেখা সাহিত্যের সত্য, আমার অনুমানও সেই সত্যেরই আর এক রূপ।