(ঈশ্বরীতলার রূপোকথা)
ইলিশ আর গঙ্গা নিয়ে যে উপন্যাস “গঙ্গা একটি নদীর নাম” সেখানে আছে ‘সন্ন্যাসী কাঁকড়া’ আর শীতল পাটি মাছের কথা। তারা সব ওৎ পেতে থাকে ইলিশের ডিম খেয়ে নেওয়ার জন্য।
“গঙ্গার পেটের ভেতর যেখানটায় যেখানটায় মাটির থাক ভাগ হয়ে চাকমতো হয়ে আছে সেখানটায় গাভিন ইলিশের দল বুড়বুড়ি কেটে ডিম ছাড়ছে। ওরা জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে সমুদ্র থেকে এসেছে। ভাটির টানে ভোর রাতে পেটখালি করে সাগরে ফিরে যাবে। পেট খালাসের সময় ইলিশের পেটে ব্যথা হয় নিশ্চয়। জলের নীচে অন্ধকারে রাস্তা চিনে চিনে আসা। অন্ধকারের নিজের একটা আলো আছে। সে আলো জেগে ওঠে ইলিশের চোখে মণিতে। ভারী পেট নিয়ে নড়াচড়া এক অস্বস্তি। সবাই তো সেখানে হাঁ করে আছে খাবার জন্যে। দূর থেকে বিটকেল সব মাছ আসে। কোনোটা আবার খানিক মাছ খানিক কিম্ভূত শরীর নিয়ে ওদের হাঁমুখে পড়ে যাওয়ার বিপদ সব সময়। আড়াল আবডালের জন্য ঝাঁক ধরে ইলিশেরা কখনো যায় হলদি নদীর মুখে নয়াচরের তলার দিকে। চরটা ওপর ওপর দেখনসই। ওপর দিকে ঠিকই আছে। কিন্তু ঘূর্ণি স্রোতে জলের নীচে নয়াচরের পায়ের দিকটা প্রায় ফোপরা। ওখানে পেট খালাস করে ডিম ছাড়া যায়। কিন্তু সন্ন্যাসী কাঁকড়াগুলো, শীতলপাটি মাছ ওৎ পেতে আছে।”
(গঙ্গা একটি নদীর নাম)
জন্ম মৃত্যু, বেঁচে থাকা সবই যেন একই সূত্রে গেঁথে গেছেন শ্যামলবাবু। ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ থেকে ‘গঙ্গা একটি নদীর নাম’— সমস্ত গল্প ও উপন্যাসে। সময় কম নয়। পঁয়ত্রিশ বছর কেটে গেছে হয়ত এরই ভিতরে।
“গঙ্গা একটি নদীর নাম”-এ আছে এক ভয়ানক মৃত্যুর কথা। মাছমারা হাজরা হালদার ভুটভুটি, জাল সব ভাড়া করে গঙ্গায় ইলিশ ধরতে ভেসে যায়। সঙ্গে যে আছে, সেই মুকুন্দর এই প্রথম জলযাত্রা, তাও রোখে পড়ে। ভুটভুটিতে চাল ডাল নুন তেল কেরসিন আর বরফ, সঙ্গে কাঠের গুঁড়োতে ভরা বস্তা। ভাসতে ভাসতে বড় লালমোহন ভেটকি, পায়রাচাঁদা, বড় গাঙের সাপ, আড়ট্যাংরা ধরা পড়েছে। তারা আছে ভুটভুটি নৌকোর খোলে। তারপর এক সময় ধরা পড়ে ইলিশ। সেই ইলিশ ধরার বর্ণনা বড় ভয়ঙ্কর। ইলিশের নীচে চাপা পড়ে যায় ভেটকি পায়রাচাঁদা। কাঁচা ইলিশের চাপে বরফ গলে যায়। জল থেকে ছিটকে ইলিশ পড়েছে ইঞ্জিনে। যন্ত্রপাতি সব চাপা পড়ে গেছে ইলিশে। এক একটা ইলিশ এক একটা বড় নোট। পচন ধরল ইলিশে। ভুটভুটি বিকল। সমুদ্রে ভাসছে তা। সঙ্গী মুকুন্দর উন্মাদ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। তার ভয় সে আর ফিরতে পারবে কিনা। ইলিশগুলো নিয়ে ফিরতে পারলে সংসারের হাল ফিরত হাজরা হালদারের। পচা ইলিশ করে তুলল তাকে বিপন্ন। বড় গাঙকে পচা গলা ইলিশ ফিরিয়ে দিয়ে কোনো রকমে বেঁচে ফিরতে চায় সে। বেঁচে থাকা টিকে থাকা যে কত কঠিন কাজ তা শ্যামলবাবুকে পাঠ করলে ধরা যায়। কাঠের গুঁড়ো, বরফ, জাল, নৌকো নিয়ে ইলিশ ধরতে বেরিয়ে বরফ গলে যায়, মাছের দেখা মেলে না। আবার বরফ যখন শেষ, তখন আসে রূপোলী ইলিশের ঝাঁক। কে কীভাবে টিকে যায়, টিকে থাকতে কাকে কতটা কী করতে হয় তার আশ্চর্য বিবরণ আছে এই উপন্যাসে। টিকে থাকা আর না টিকতে পারা এইই তো তাঁর অনুসন্ধান।
ফিরে যাই ঈশ্বরীতলার রূপোকথায়।
ঈশ্বরীতলা…তে পাতিহাঁসের ঘরে সাপ ঢুকে ফণা তোলে। দুটি হাঁস ভয়েই মারা যায়। নিরুপায় ভীতু প্রাণ। বাওড় থেকে নদীর আমলের পেল্লাই মহাশোল ধরতে ব্যাঙের গর্ত খুঁড়ে ব্যাঙ খুঁজে বেড়ায় মদন বদন। মহাশোল লোভে পড়ে ব্যাঙ খাবে। তারপর মহাশোলটিকে খাবে মানুষ। অনাথের চাষ করা ধান খেয়ে ফেলে মাংসল ঢেউ তোলা ক্রিমি-মাজরা পোকা। কী ধান হয়েছিল যে—লকলকে সবুজ, চওড়া পাতা তার। তখন গর্ভথোড়ে দুধ আসার কথা। কিন্তু ভিতরে ভিতরে যে সব ফোঁপরা হয়ে গেছে কে বুঝবে? ক্রিমিরা সময় সময় সুযোগ মতো নেমে পড়েছিল কাজে। অনাথবন্ধু ধানের মোটা গোছের যেখানেই হাত দেয় সেখান থেকেই শ্বেত প্রজাপতির দল উড়ে যায়। এই প্রজাপতিদের যাদের বাঁ পাখনায় একটা করে কালোফুটকি- তারা মাদী, মাজরা পোকা- ঢেউতোলা ক্রিমির জননী। মাজরা পোকাও তাহলে ধানের থোড় খেয়ে শাদা প্রজাপতি হবে। ধান বাঁচল না। বাঁচল না বটে, কিন্তু ওই ঢেউতোলা ক্রিমি, যা থেকে জন্ম হবে প্রজাপতির তাদের মারতে বিষ ছড়ানো হবে ধানের গায়ে। এই মৃত্যু-কীট পতঙ্গ থেকে না-জানা প্রাণী মানুষের অভিজ্ঞতা এসে পৌঁছয় সংহতি কলোনির শুকনো পুকুর পাড়ের গর্তে বাস করা এক অদ্ভুত প্রাণীতে। কেউই টেকে না, বাঁচেনা, বালি ঝড়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় অতিকায় ডায়নোসর, এরপরেও বেঁচে থাকে বাঘডাঁশা, লুকিয়ে থাকে এই ভূমণ্ডলে। তার ভিতরেই জেনেটিক ইঞ্জিনীয়ার এলসা টিচবোর্ণ প্রত্যক্ষ করে ডায়নোসরের শেষ চিহ্নটিকে।
পৃথিবীটা খাদ্য-খাদকের, দখলদারির, দখলকারের, নারী পুরুষের। জমি মাটি এবং নারী দখল করতেই কুবেরের যাত্রা জীবনের এই পথে। জমি মাটি দেয় ফসল। ফসলের কামনা কি লুকিয়ে থাকে না দখলের প্রবল ইচ্ছার ভিতরে? আর নারী দখলের ভিতরেও তো লুকিয়ে থাকে যেন ওই একই সূত্র। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় এইভাবে ভেবেছেন, জাগতিক পৃথিবীকে দেখেছেন। ‘কুবেরের বিষয় আশয়’ উপন্যাসটি লোভের, দখলের এবং আশ্চর্য এক স্বপ্নপূরণের আকাঙক্ষার দীর্ঘ আখ্যান। আমাদের গল্প উপন্যাসে যে এক চতুর কাহিনী সবসময়ই বয়ন করা হয়, যার আরম্ভ থাকে, শেষ থাকে, ফলে পাঠকের তাকে অনুসরণ করতে অসুবিধে হয় না, দরকারে মুখে মুখে কাহিনীটি বলে নিলেও চলে, কুবেরের বিষয় আশয় উপন্যাসটিতে সেই কাহিনী বয়ন তো নেইই, বরং আছে জমি মাটি নারী প্রকৃতিকে ধীরে ধীরে আত্মস্থ করার তীব্র প্রয়াস। জমি কেনাবেচা করতে করতে কুবের সাধুখাঁ জমি মাটির মায়ায় বশীভূত হয়। জমি কেনাবেচা করতে করতে তার হাতে টাকা আসে। টাকা নাড়াচাড়া করতে করতে কত কী! আবার জমি তো শুধু বেচা কেনা নয়, তা থেকে ফসল তোলা যায়। মেদন মল্লর চরে চাষবাসে টাকা ঢেলে বসে কুবের। তাকে ভদ্রেশ্বর স্বপ্ন দেখায় সে কালে কালে চকদার হয়ে উঠবে, কিয়ৎকালের মধ্যে তার মতো চাষী এই ভূমণ্ডলে আর কেউ থাকবে না।